বর্ধমানের ক্ষীর গ্রাম। মঙ্গলকোটের অন্তর্গত এই গ্রাম ভারতের একান্ন পীঠের মধ্যে অন্যতম সতী পীঠ। দেবী মহামায়ার বুড়ো আঙুলের অংশ পড়েছিল এই স্থানে। ক্ষীরগ্রামে দেবী ‘ যোগাদ্যা’ নামে অধিষ্ঠাত্রী। মার্কেণ্ডেয় পুরাণে উল্লেখ মেলে।
অবধূত রামায়ন একটি কাহিনী পাওয়া যায়।
সীতা উদ্ধারের জন্য রামচন্দ্র এবং লঙ্কেশ্বর রাবণের যুদ্ধ চলছে। রাবণ পুত্র মহীরাবণ উগ্রচন্ডা মহাকালীর উপাসক। সেই দেবীই যোগাদ্যা। যুদ্ধের সময় মায়ায় বিবশ করে রাম-লক্ষ্মণকে পাতালের গর্ভগৃহে নিয়ে যান মহীরাবণ। উদ্দেশ্য দেবীর কাছে নরবলি দেওয়া। এমত যখন অবস্থা সেখানেও উপস্থিত হন মহাবলি বীর হনুমান। তিনি কৌশলে মহীরাবণ আর অহিরাবণকে বলি দিলেন দেবীর কাছে। পাতালের অন্ধকার থেকে উদ্ধার হলেন রামচন্দ্র আর লক্ষ্মণ।
ফেরার সময় তাঁরা দেবী যোগাদ্যাকেও পাতাল থেকে নিজেদের সঙ্গে আনেন।
কথিত আছে, ক্ষীর গ্রামের রাজা হরি দত্ত স্বপ্নে পেয়েছিলেন দেবী যোগাদ্যাকে। তাঁর পুত্র ভরত পরে ক্ষীর গ্রামের রাজা হন। তাঁরা ছিলেন ছয় ভাই। এঁরা মল্ল বীর নামে পরিচিত ছিলেন।
ক্ষীরগ্রামের পশ্চিমে দেবী যোগাদ্যার মন্দির। সিংহপৃষ্ঠে আসীন কালো কোষ্ঠীপাথরের দশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি। কিন্তু দেবী সেই মন্দিরে থাকেন না। মন্দির লাগোয়া ক্ষীরদিঘির জলে দেবীর বাস।
বছরে মাত্র ৬ দিন দেবী জল থেকে স্থলে আসীন হন। তার মাত্র দু’ দিন ভক্তরা দেবীর দর্শন পান। বৈশাখ সংক্রান্তির আগের দিন এবং জ্যৈষ্ঠের ৪ তারিখে। বাকি চার দিন, আষাঢ়ী নবমী, বিজয়াদশমী, ১৫ পৌষ এবং মাঘ মাসের মাকরী সপ্তমীতে দেবীকে জল থেকে তুলে পুজো করা হলেও তাঁকে দেখাতে পান না সাধারণ মানুষজন।
শোনা যায়, প্রাচীন যোগাদ্যা মূর্তিটি কোনও ভাবে হারিয়ে গিয়েছিল। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তি চন্দ এই গ্রামে যোগাদ্যার একটি মন্দির নির্মাণ করান। এবং সম্ভবত তাঁরই আদেশে হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটির অনুকরণে একটি দশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি তৈরি করেন দাঁইহাটের প্রস্তর শিল্পী নবীনচন্দ্র ভাস্কর। পুরনো মূর্তি ফিরে পাওয়ার পর নতুন একটি মন্দির স্থাপন করা হয়। এখন দুই মন্দিরেই চলে দেবীর পুজো।
গবেষক যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী জানিয়েছেন, এই জনপদে অন্তত ৪০টি যোগাদ্যা বন্দনা পুঁথি মিলেছে। তবে তাঁর মতে, সবথেকে আগে যোগাদ্যা বন্দনা লিখেছিলেন কবি কৃত্তিবাস। কবির মতে, রামায়ণের কালে মহীরাবণ বধের পরে তাঁরই পূজিতা ভদ্রকালী বা যোগাদ্যাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেন রামচন্দ্র।
ক্ষীর দীঘি নিয়েও কাহিনীর শেষ নেই। সতী পীঠে কান পাতলেই শোনা যায় সে সব কাহিনী।
একবার ক্ষীর দীঘির পাড়ে বসে নোয়া পরছিল একটি ছোট্ট মেয়ে। শাঁখারী দাম চাইলে মেয়েটি বলে তার বাবা পুরোহিত। সে-ই তার দাম মেটাবে। শাঁখারী যায় পুরোহিতের কাছে। শাঁখার দাম চায়। সব কথা পুরোহিত তো অবাক!শাঁখারীকে নিয়ে এলেন ক্ষীর নদীর পাড়ে। কোত্থাও কেউ নেই! শেষে দীঘির জলে তাঁরা দেখেন দুটো হাত। নতুন শাঁখা আর পলায় সে হাতে ভর্তি!
দেবী যোগাদ্যা’র আরাধনায় শাঁখা তাই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষীর গ্রামের মানুষের কাছে যার নাম ‘মাসিপিসির ঝাঁপি’। সিঁদুর, শাঁখা, আলতা, নোয়া, শাড়ি থাকে এই ঝাঁপিতে। পুজোর দুন পরিষদ এবং আচার্য্য আসেন মন্দিরে ঝাঁপি নিয়ে। সঙ্গে থাকে পাইক। আচার্য্যের এক হাতে ঝাঁপি আর এক হাতে পাখা। বাজনা, বাদ্যি বাজিয়ে মন্দিরে আসেন। আচার্য্য দেবীকে শাঁখা পরান।
যোগাদ্যা দেবীকে ঘিরে পুজোর কদিন নানা অনুষ্ঠান হয়।
বৈশাখের বেশ কয়েকটা দিন ক্ষীরগাঁয়ের মানুষদের আচার- বিচারে নানা বাধানিষেধ মেনে চলতে হয়। বন্ধ থাকে চাষের কাজ। বৈশাখ সংক্রান্তির আগের দিন কলস নিয়ে গ্রাম পরিক্রমা চলে। কলসে ভরা থাকে ক্ষীর দীঘির জল। চাষের জমিতে ছিটানো হয়। স্থানীয় ধারণা এতে উর্বর হয় জমি।
দেবীর পুজোর একাধিক পর্ব আছে। মহারাজ হরি দত্তের বংশধররা আজও পুজোয় প্রত্যক্ষ অংশ নেন। একসময় নরবলি হত। এখন তার বদলে পশুবলী হয়। পুজোর শেষে দেবী আবার জলে অবগাহন করেন। এ বিসর্জন নয়, স্বস্থানে ফিরিয়ে দেওয়া।