পায়ে পড়ি বাঘ মামা, করো না কো রাগ মামা। তুমি যে এ ঘরে কে তা জানত? হীরক রাজের কোষাগারে গুপী-বাঘা হানা দিয়ে বাঘকে দেখেই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারা হয়ত দক্ষিণ রায়ের কথা জানতেন না। হ্যাঁ, দক্ষিণ রায়! দক্ষিণ রায় হলেন সেই বাঘ মামাদের দেবতা। তারই পুজো হয় আমাদের বাংলায়। তার অবয়বও মানুষের মতোই। দক্ষিণরায় বা বারা ঠাকুর হলেন বাঘ, মোম-মধুর দেবতা। তাঁর আবির্ভাব মধ্যযুগে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, দক্ষিণ রায় এক সময় রক্ত-মাংসের দেহধারী মানুষই ছিলেন, যিনি পরবর্তীকালে লৌকিক দেবতায় পরিণত হয়েছেন। দক্ষিণ রায়ের মতো তার মূর্তি পুরোপুরি মানবীয়। তবে পোশাক পৌরাণিক দেবতার মতো। তার হাতে টাঙ্গি ও ঢাল, কোমরবন্ধে নানা অস্ত্র ঝোলানো। পীঠে তীর-ধনুক। দক্ষিণ রায় হলেন বাঘসহ সুন্দরবনের সমস্ত পশু ও জঙ্গলের দানবদের নিয়ন্ত্রক। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে গোটা সুন্দরবন অঞ্চলে তিনি পুজো পান।
প্রচলিত বিশ্বাস, লোককথা এবং ধর্মবিশ্বাসের মিলনেই এই লোকদেবতা দক্ষিণ রায়ের সৃষ্টি। লোককথা থেকে তাঁর চেহারার বর্ণনা পাওয়া যায় এইরকম –
শীর্ণ শরীর, হরিদ্রাভ গায়ের রং, উজ্জ্বল গায়ের ত্বক, সারা গায়ে বাঘের মতো ডোরাকাটা দাগ, বিরাট পাকানো গোঁফ, মুখের দু’দিক থেকে ঝরছে লালা, আর লম্বা একটি লেজ। সর্বদা তীর-ধনুক, ঢাল-তলোয়ার-বল্লম নিয়ে যুদ্ধসাজে সজ্জিত তিনি। তবে লেজটি আসলে পোশাকের লেজ, তাঁর শরীরের লেজ নয়।
পোড়া শোল মাছ, রান্না করা খাসির মাংস, মদ, গাঁজা, সিদ্ধি, তাড়ি দিয়ে দক্ষিণরায়ের নৈবেদ্য। বারুইপুরের ধপধপিতে ও লক্ষ্মীকান্তপুরে স্থায়ী পাকা মন্দিরে আছে তাঁর মূর্তি। এছাড়াও বনের মধ্যে মাটির মূর্তি নিয়ে গিয়ে মানত চুকোতে বিক্ষিপ্ত ভাবে পুজো হয় এই বাঘদেবতার। একবিংশ শতকে সুন্দরবনের অরণ্য পরিসর ক্রমশ কমে আসছে, সেখানে বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়ের গুরুত্বও কমে আসছে অনেক।
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষদের লোকদেবতা দক্ষিণ রায়। সকলের কাছেই তিনি ভাটি অঞ্চলের অধিপতি হিসেবে পরিচিত, যা যশোরের ব্রাহ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের অধীনস্থ অঞ্চল। ওনার মায়ের নাম নারায়ণী। বনদেবতা হিসাবে পুজো পেলেও, মনে করা হয় তিনি আদতে রাজা প্রতাপাদিত্যের সেনানায়ক। মদন রায়ের বংশধর।
ষোড়শ শতকে দক্ষিণ রায়ের রাজত্বের সীমানা ছিল পূর্বে বাকলা জেলা, পশ্চিমে ঘাটাল, উত্তরে ভাগীরথী এবং দক্ষিণে কাকদ্বীপ। বর্তমানে তিনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা এবং সুন্দরবনের অঞ্চলেরই আরাধ্য দেবতা। ১৬৮৬-৮৭ সাল নাগাদ লোককবি কৃষ্ণরাম দাসের রচিত “রায়মঙ্গল” কাব্যতে দক্ষিণ রায়ের বিষয়ে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে।
বারুইপুরের ধপধপিতে রয়েছে দক্ষিণ রায়ের মন্দির। বহু বছর ধরে পুজো হলেও একতলা মন্দিরটি ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সময়ের সরণি বেয়ে দক্ষিণ রায়ের নাম বদলে দক্ষিণেশ্বর হয়ে গিয়েছে। মন্দিরে নিত্য পুজো হয়। শনি, মঙ্গলবার বিশেষ পুজো হয়। ১লা মাঘ দক্ষিণ রায়ের জন্মদিনে বিশেষ পুজো হয় যা জাতাল উৎসব নামে পরিচিত। নীল উৎসব এবং শিবরাত্রি পালন করা হয়, কোথাও গিয়ে যেন শিব আর দক্ষিণ রায় মিলে গিয়েছে। অম্বুবাচিও পালন করা হয়। মন্দিরে এখনও পশুবলির চল রয়েছে। মানত পূরণ হলে ছোট বড় দক্ষিণ রায়ের মূর্তি দিয়ে মন্দিরে পুজো দেওয়া হয়। দক্ষিণ রায় খুব গান-বাজনা পছন্দ করেন, পুজোর তাঁর মন্দিরে সারারাত নাচ-গানের আসর চলে।
মন্দিরের স্থপত্যে ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। চূড়ায় দেবশিশু, দুপা তুলে দাঁড়ানো ঘোড়া, গোলাকার ফুলের স্তবক এবং চূড়োর কারুকার্য নকশা, প্রমান করে এই মন্দির ব্রিটিশ ভারতেই তৈরি হয়েছিল।
মন্দিরের বারান্দা পেরিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে হয়। মন্দিরের ভিতরে দক্ষিণ রায়ের প্রায় সাত ফুট উচ্চতা বিশিষ্ঠ মাটির মূর্তি রয়েছে। প্রচলিত বিবরণ অনুযায়িই, দক্ষিণ রায়ের মূর্তিটি মানবীয়, সাদা গায়ের রং, মোটা কালো গোঁফ, বড়ো বড়ো চোখ, পরনে জামা-ধুতি-বুট, মাথায় মুকুট। কোলে রয়েছে একটি বন্দুক। পিছনের দেওয়ালে রয়েছে কাগজ ও কাঠের তৈরী বিভিন্ন অস্ত্র-শস্ত্র।
এছাড়াও বিগ্রহের পায়ের কাছে রয়েছে একটি বড় পাথর ও একজোড়া খড়ম, যা মন্দির ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার বহু বছর আগে থেকেই পূজা হয়ে আসছে।
সময়টা ষোড়শ শতক সুন্দরবন তখন বিস্তীর্ন এলাকা। ঐ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তখন চারজনের নাম উঠে এসেছে। এরা হলেন দক্ষিণ রায়, ধনাই বণিক, মনাই বণিক ও বড় খাঁ গাজী। কেউ কেউ বলেন দক্ষিণ রায় কিন্তু এক সময় রক্ত-মাংসের দেহধারী মানুষই ছিলেন, যিনি পরবর্তীকালে লৌকিক দেবতায় পরিণত হয়েছেন।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় জন হলেন ধনাই বণিক ও মনাই বণিক। সুন্দরবন এলাকার মাছ, কাঠ ও মধুর ব্যাবসায়ী ছিলেন এরা প্রভূত সম্পদের মালিক।
চতুর্থ জন হলেন ‘বড় খাঁ গাজী’। ইসালামধর্মের প্রচারক এই যোদ্ধার পরিচয় নিয়ে নানান মত রয়েছে। একটি মতে, হুগলি জেলার পাণ্ডুয়ার পীর জাফর খাঁ গাজীর ছেলে এই বড় খাঁ গাজী। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি পীর সুফি খান।
তবে মধ্যযুগের বাংলায় ইসলাম ধর্মপ্রচারকদের শীর্ষ ব্যক্তিরাই “বড় খাঁ গাজী” নামে পরিচিত হন। যেমন কলকাতার সোনাগাছির নাম, যার নামে হয়েছে সেই পীর সোনা গাজী, ঠিক তেমনটাই। দক্ষিণ রায় ও এই গাজীর মধ্যে অদ্ভুত এক মিল রয়েছে। ইসলামধর্মের প্রচারক এই গাজীও বাঘের দেবতা। গাজী পায়জামা, চোগাচাপকান, পিরাণ পরিহিত এক ঘোড়সওয়ার যোদ্ধা। কিছু অঞ্চলে এনাকেও কিন্তু লোকদেবতা হিসেবে পুজো করা হয়।
এলাকার জনশ্রুতি ও লোককথা থেকে জানা যায়, স্থানীয় হিন্দুদের জোর করে ভয় দেখিয়ে বা প্রলোভনের মাধ্যমে ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে গিয়ে, বহুবার এলাকার দেবতা দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে গাজীর বিরোধ ঘটে এবং শেষে যুদ্ধ হয়। এতেই প্রমাণ হয়, দক্ষিণ রায় মানুষ ছিলেন। কারণ দেবতার সাথে মানুষের যুদ্ধ হয় না! এই যুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসেবে, মানুষের লোককথায় রক্ত-মাংসের মানুষ দক্ষিণ রায় পরিণত হন লৌকিক দেবতায়। আর সেই কারণেই ওনার মূর্তির সাথে এতো অস্ত্র, সারারাত ধরে গান বাজনা করে পরোক্ষভাবে পাহারা দেবার কাজ সম্পাদন করা।
বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে গাজি পিরের যুদ্ধের বর্ণনা রয়েছে কৃষ্ণরাম দাসের ‘রায়মঙ্গল’ কাব্যে, ঈশ্বর এই যুদ্ধ থামানোর জন্য অর্ধেক হিন্দু অর্ধেক মুসলমান দেবতা কৃষ্ণপয়গম্বরের রূপ নিলেন।
বিচিত্র তাঁর রূপটি হল –
“অর্দ্ধেক মাথায় কালা একভাগা চুড়া টালা
বনমালা ছিলিমিলী তাতে।
ধবল অর্দ্ধেক কায় অর্দ্ধ নীলমেঘ প্রায়
কোরান পুরাণ দুই হাতে”।
গাজি এবং দক্ষিণ রায়কে শান্ত করলেন তিনি। যুদ্ধবিরতি হল। গাজী ও দক্ষিণরায়ের যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী, কুমীর-দেবতা কালুরায় হিজলীর শ্রদ্ধা-সম্মানের অধিকার লাভ করেন। সুন্দরবনের ভাটি অঞ্চলে দক্ষিণ রায়, হিজলিতে কালু রায়, আর গোটা সুন্দরবনেই গাজি পির শ্রদ্ধা এবং সম্মান লাভ করবেন। কুমিরের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কুমিরদেবতা কালু রায়ের পুজো করা হয়। তাঁর পোশাক পৌরাণিক যুদ্ধ-দেবতার মতো। দুই হাতে টাঙ্গি ও ঢাল, কোমরবন্ধে নানা অস্ত্র ঝোলানো, পিঠে তির-ধনুক। আরণ্যক দেবতার প্রাচীন পুজোপদ্ধতি মেনে কালু রায়ের পুজোয় বনঝাউ ফুলের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। এই কালু রায় কিন্তু রাঢ় বাংলার ধর্ম ঠাকুর কালু রায় নয়।
আবার 'গাজিমঙ্গল’ বা ‘গাজির গান’-এ রয়েছে অন্য কথা। গাজি গান অনুযায়ী, গাজি সাহেবের কাছে দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়েছিলেন। আবার আব্দুল গফুরের ‘কালু গাজী ও চম্পাবতী’ কাব্যে দেখা যায়, সমস্ত হিন্দু দেবদেবী হয়ে উঠেছে গাজি পিরের বন্ধু এবং পরম আত্মীয়।
আবার সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ‘বনবিবির জহুরানামা’ নামে বনের দেবদেবীর কাহিনী পরিবেশিত হয়। মনে করা হয়, পির ও সুফিরাই এই সব কাহিনির জন্মদাতা। উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে এর লিখিত নিদর্শন পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে এর নানান সংস্করণের প্রচলন রয়েছে। এর মধ্যেও দক্ষিণ রায়ের বর্ণনা রয়েছে।
পালার প্রথম অংশে থাকে বনবিবি ও তার ভাই শাহ জংলির জন্ম ও বড় হয়ে ওঠার গল্প। বনদেবী নারায়ণীও বাঘের দেবতা বলে পরিচিত। মধ্যযুগ থেকে তাঁর পুজো হয়ে আসছে। লোকালয়ের আশপাশের বনবাদাড়ে বনদেবী নারায়ণীর থান রয়েছে, বেশিরভাগই মাটির দেয়াল খড় অথবা টালির ছাউনি দেওয়া ঘর।
দ্বিতীয় ভাগে দক্ষিণ রায়ের মা নারায়ণীর সঙ্গে বনবিবির লড়াইয়ের কাহিনী বর্ণনা করা হয়। যুদ্ধে বনবিবি জয়ী হলে নারায়ণী সম্পূর্ণ বাদাবনের কর্তৃত্ব ছেড়ে দিতে রাজি হন। কিন্তু বনবিবি নারায়ণীর সঙ্গে সই পাতিয়ে এক সঙ্গে রাজ্য শাসন করতে থাকেন।
কাহিনির তৃতীয় ভাগ হল দুখে যাত্রা। দুখে পিতৃহীন গরিব ছেলে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় গ্রামের ধনা মউলি ও তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে জঙ্গলে যায়। দক্ষিণ রায় মউলিদের বলেন তাঁর কাছে দুখেকে বলি দিলে প্রচুর পরিমাণ মধুর সন্ধান দেবেন। অন্যথায় তাঁদের সর্বনাশ হবে। ধনা রাজি হয়ে যান। ছলনা করে দুখেকে জঙ্গলে ফেলে তাঁরা নৌকা ছেড়ে দেন। দক্ষিণ রায় বাঘ রূপে তাকে মারতে গেলে দুখে বনবিবির কাছে প্রার্থনা জানায়। বনবিবি এবং শাহ জংলি এসে দক্ষিণ রায়কে হারিয়ে দুখেকে বাঁচান। দক্ষিণ রায় বড় খাঁ গাজির কাছে আশ্রয় নেয়। বড় গাজির মধ্যস্থতায় দক্ষিণ রায় ও বনবিবির মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়। দুখে দক্ষিণ রায়ের কাছ থেকে সাত ঘড়া মোহর পেয়ে মায়ের কাছে ফেরে। শুরু করে বনবিবির মাহাত্ম্য প্রচার। কাঠুরে বা মউলিরা বনবিবির ভরসায় দক্ষিণ রায়ের ডেরায় নিজেদের সুরক্ষিত মনে করেন, দেবীর আশীর্বাদ নিয়ে জঙ্গলে ঢোকেন।
নারায়ণীর জং এবং দুখের যাত্রা, দুটি পর্বেই সহাবস্থানের কথা রয়েছে। নারায়ণী দক্ষিণ রায় এবং বনবিবি শাহ জংলি, দু-পক্ষই একে অপরের অস্তিত্ব মেনে নিয়েছেন।
এইভাবেই মানুষের জীবন জীবিকার সঙ্গে মিশে গিয়েছেন দক্ষিণ রায়। আজও তার ভরসাতেই জীবনধারণের রসদ সংগ্রহের জন্য জঙ্গলে প্রবেশ করেন জেলে, কাঠুরিয়া, মাঝি-মল্লা, মধুর কারবারিরা।