কুন্তীর আশীর্বাদে ধরায় অমর ফুচকা!

“১০ টাকায় কটা”?

“শালপাতা আছে তো”?

“বেশি করে ঝাল দিও। গুঁড়ো লঙ্কা নয় কিন্তু কাঁচালঙ্কা”।

স্কুল ছুটির পর হোক বা ছুটির দিনে মন ফুরফুরে আবেশ। ভিক্টোরিয়ায় কলেজ প্রেম। ইউনিভার্সিটির গেটে হঠাৎ দেখায় সব কিছুতেই তাকে চাই। রসগোল্লার মত এই বস্তুটিও বাংলার নিজস্ব সিগনেচার। ফুচকা।

বিকেল হলেই রাস্তার ধারে লাল কাপড়ে ঢাকা বেতের ঝুড়ি ঘিরে কী যে অমোঘ আকর্ষণ! অন্য যে কোনও লাইনে দাঁড়াতে বাঙালির সমস্যা থাকলেও ফুচকার লাইনে দাঁড়াতে তার কোনও রাগ-বিরক্তি হয় না।

ফুচকা বিজয়রথ কবে যাত্রা শুরু করেছিল তার কোনও সন তারিখ বা ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিসের বিররণে চাল দিয়ে তৈরি এক ধরনের ফুচকা জাতীয় খাবারের উল্লেখ মেলে।

মধ্য-বিহারের পাটলিপুত্রে তখন মৌর্য রাজত্ব চলছে। সেই সময় মেগাস্থিনিস ভারতে এসেছিলেন। সেই ভ্রমণ বৃত্তান্ত পাওয়া যায় ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে। তার পাতাতেই খোঁজ মিলেছে প্রাচীনতম ফুচকার।  

ফুচকা নিয়ে আরও একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। সে কাহিনি মহাভারতের পাতায়। পঞ্চপান্ডব তখন প্রথম অজ্ঞাতবাসে। অরণ্যে অরণ্যে কৃচ্ছসাধন। সে সময়ই পাঞ্চাল রাজের কন্যা দ্রৌপদী এলেন কুন্তির সংসারে।

একদিন কুন্তী রান্নার পরীক্ষা নিলেন পুত্রবধূর। সামান্য উপাদান দিয়েই কতটা ভালো রান্না করতে পারেন পাঞ্চালকন্যা। পাকঘরে গিয়ে দ্রৌপদি আবিষ্কার করলেন আগের দিনের সবজি ছাড়া আর কিছু নেই। গোধুমচূর্ণ এবং সেই সব্জি দিয়েই তিনি তৈরি করে ফেলেন একটি পদ। এভাবেই আবিষ্কার হয় ফুচকা। কুন্তী সেই ফুচকা খেয়ে এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, ‘ফুচকা’কে অমরত্বের আশির্বাদ দেন।

দ্রৌপদীর হেঁশেলের বেঁচে যাওয়া তরকারী পরবর্তীকালে বদলে গিয়ে হয় আলু সেদ্ধতে।

ভারতের সব প্রদেশে অবশ্য ফুচকার পুর এক নয়। যেমন মহারাষ্ট্রে ‘হট রগড়া’ মানে মটর বা কড়াইশুঁটির গরম পুর থাকে ফুচকার ভিতরে। গুজরাটে সেদ্ধ আলুর সঙ্গে দেওয়া হয় মুগডাল। কর্ণাটকে আলুর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয় পেঁয়াজকুচো।

উত্তর ভারতে ফুচকার ডাকনাম অনেক।‘গোলগাপ্পে’, ‘গুপছুপ’, ‘পানি কে পতাসে’, ‘ফুলকি’ নানান নামে ডাকা হয় হালকাফুলকা এই ‘স্ন্যাক্স’কে।

ফুচকা কতটা ভালো তা নির্ভর করে ফুচকার ভিতরের পুরের ওপর। এখানেও আছে রাজ্য-রাজ্যে লড়াই। যেমন কলকাতার ফুচকাপ্রেমিরা উত্তরের লেবুর জলভরা ফুচকা একেবারেই না-পসন্দ। তাদের জিভে সবসময় বসত করে তেঁতুল জলের স্বাদ। বীট লবণ আর গন্ধরাজ লেবুর রাজকীয় সুবাস।

মধ্যপ্রদেশের হাসনাবাদে ফুচকাকে ডাকা হয় ‘টিক্কি’ নামে।

কিন্তু বাংলাতেই গোলগাল হালকাপলকা খাবারকে বলা হয় ‘ফুচকা’। তেঁতুল জল আর ঝাল আলুর পুর ভরা বস্তুটি মুখের মধ্যে পুরে কামড় বসালেই জল ছিটকে আসে। শব্দ হয় ‘ফুচ’ করে। সেই থেকেই নাম হয়ে যায় ফুচকা।

ফুচকা তৈরি হয় আটা আর সুজি দিয়ে। নিটোল চেহারা নির্ভর করে এই দুই উপাদানের যথাযথ অনুপাতের ওপর।

ফুচকার আকার সব জায়গায় এক হলেও স্বাদের রহস্যটা পুরের কাছেই বাঁধা। পুর-ই ঠিক করে দেয় কোন ফুচকার স্টলে কতটা ভিড় হবে। স্যালাডের পুর, ঘুগনির পুর, টক-ঝাল-মিষ্টি জল, ধনেপাতা এমনকি পুদিনাপাতাও ফুচকার ফ্যাশন স্টেটমেন্টে ঢুকে পড়েছে আজকাল। তবে বাঙালি ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ পরখ করতে ভালোবাসলেও ফুচকার ক্ষেত্রে তারা কিন্তু বেশ ট্রাডিশনাল। আলু-তেঁতুল-ছোলা বাটা কাঁচালঙ্কা গোপন মশলায় পুরনো ফুচকার স্বাদই পছন্দ করে। সেখানে আজও কোনও পরিবর্তন আসেনি।

কলকাতার ফুচকা বার উত্তর এবং দক্ষিণ ভেদে আলাদা আলাদা। স্বাদ, গন্ধ এবং ঐতিহ্যে টক্কর চলেই। কলকাতায় ফুচকারা বেশির ভাগই ভিন রাজ্য থেকে আসেন। তাঁদের হাতে কী যে যাদু থাকে সে রহস্য আজও ভেদ করতে সক্ষম হয়নি কোনও গোয়েন্দা!

প্রত্যেকের আলাদা আলাদা পছন্দের খেয়াল রাখা। ফুচকার সংখ্যাতেও কোনও গোলমাল নেই। তুখোড় কায়দায় এভাবেই সন্ধের ‘প্রাইম টাইমে’ ভিড় সামলে চলেন তাঁরা।

এখন অবশ্য করোনার আবহে ‘ফুচকাওয়ালা’র স্টল ঘিরে চেনা ছবিটা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। করোনায় স্বাস্থ্যবিধি ও নির্দেশিকা মানতে হচ্ছে। মাস্ক থাকলে তবেই মিলবে পাতা। ফুচকার লাইনে দাঁড়ালেই হাত ধুতে হবে স্যানেটাইজার দিয়ে। দাঁড়াতে হবে দুরত্ব বজায় রেখে। তবেই মিলবে ফুচকা!

 

 

 

 

  

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...