বাংলা শিল্পকলার এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়- গৌড়ীয় নৃত্য

ভারতের একটা বৈচিত্রময় অংশ হল বাংলা, যার স্বকীয়তা বিশ্বের দরবারে স্বীকৃত। এই বাংলার বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে আঞ্চলিক শিল্পের সমাহার, এই টুকরো টুকরো শিল্পকলার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে বাংলার ঐতিহ্য। নৃত্য, সংগীত, বাদ্য, লোকশিল্প, স্থাপত্য এই সবকিছুতেই বাংলার খ্যাতি অপরিসীম। এদের মধ্যে বাংলার একটা অতিপ্রাচীন নৃত্যশৈলীর অংশ হল গৌড়ীয় নৃত্য। ভারত তথা বাংলার নৃত্যকলা হল অনেকাংশে মন্দিরকেন্দ্রিক। বাংলায় খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে বহু নৃত্য ভাস্কর্য পাওয়া যায়। অনুমান করা হয়ে থাকে মন্দিরে দেবদাসীদের নৃত্যভঙ্গি দেখেই করা হত এই ভাস্কর্য। 

প্রাচীন বাংলার নাম ছিল গৌড় এবং বাংলায় যে নৃত্যশৈলী প্রচলিত ছিল তা গৌড়ীয় নৃত্য নামে পরিচিতি লাভ করে। এটি বাংলার শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে একটি। বিখ্যাত কাশ্মীরি লেখক কলহনের রাজতরঙ্গিনীতে উল্লেখ আছে এই নৃত্যশৈলীর। কমলা দেবদাসী যাঁর মোহময়ী নৃত্যে অভিভূত হন রাজা জয়বি এবং অবশেষে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। এভাবেই এটি জুড়ে দেয় কাশ্মীর ও বাংলাকে। এটা ছাড়াও জয়দেবের গীতগোবিন্দ, মনসামঙ্গল, ভারতীয় নাট্যশাস্ত্র এই সকল বইতে রয়েছে গৌড়ীয় নৃত্যের উল্লেখ। দেবদাসী প্রথা এখন অবলুপ্ত হলেও এককালে মন্দিরে একাধিক দেবদাসীর উপস্থিতি পরিলক্ষিত হত। তাদের নিয়োজিত করা হতো ঈশ্বরের সেবায়। পূজাকেন্দ্রিক কাজ হোক বা নৃত্যগীত পরিবেশনা তারাই করে থাকত। এই দেবদাসী আবার তিন ধরণের হত- দেবদাসী, স্বদাসী ও রাজদাসী। রাঢ়বঙ্গে দেবদাসীর প্রচলন ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। রাজদাসী ছিল যারা রাজদরবারে নৃত্য পরিবেশন করত এবং স্বদাসী ছিল সাধারণ জনগণের জন্য। 

বলা হয়ে থাকে যে গৌড়ীয় নৃত্য হলো বাংলা তথা ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন নৃত্যগুলির মধ্যে একটি এবং এর থেকেই জন্ম হয়েছে আরো অনেক নৃত্যশৈলীর যেমন- ওডিসি, মণিপুরী, কুচিপুড়ি ইত্যাদি। মন্দিরের দেবদাসীদের নাচ মনোরঞ্জনের জন্য প্রদর্শিত হত না, তার একটি ভক্তিমূলক ও আধ্যাত্মিক আঙ্গিক ছিল। সুদর্শনা মহিলারা রঙিন শাড়ি, গয়না, ফুলের অলংকার ইত্যাদির মাধ্যমে সাজিয়ে তুলতেন নিজেদের। কপালে সিঁদুরের বড় টিপ সাজের একটা বিশিষ্ট অঙ্গ ছিল। নৃত্যে ব্যবহৃত হত মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। এই নাচ আয়ত্ত করতে প্রয়োজন হত কড়া প্রশিক্ষণ ও পরিশ্রমের। এর স্বতন্ত্র অঙ্গভঙ্গি, মুখাবয়ব ও মুদ্রা এই নাচকে করে তোলে আকর্ষণীয় ও অন্য শৈলীর থেকে আলাদা। গান ও তালের ছন্দে এক বিশেষ অঙ্গভঙ্গিমায় হয় এই নাচ। পরবর্তীকালে মন্দিরের বাইরেও এই নাচের প্রতি আকর্ষিত হয় মেয়ে ও মহিলারা, তারা শেখেও। বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে গৌড়ীয় নৃত্য। ব্রিটিশদের আগমনের পর এই দেবদাসী প্রথা উঠে যায় এবং হারাতে থাকে এই আর্ট।     

গৌড় প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়ে যায় ভারত-বাংলাদেশ সীমানায়। অনেক মন্দির ও প্রাচীন স্থাপত্যে গৌড়ীয় নাচের নিদর্শন পাওয়া গেলেও তার অনেকটাই নষ্টও হয়ে গেছে অবহেলায়। কিছুটা সংগৃহিত আছে মিউজিয়ামে। গৌড়ীয় নৃত্য যা প্রকৃতপক্ষে বাংলার একটা সম্পদ তা হারিয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ সময়ের সাথে সাথে। তবে কখনো একটুও ম্লান হয়নি তার গৌরব। বিশ শতকে এই পুরানো হারিয়ে যাওয়া নৃত্যশৈলীগুলি পুনরুজ্জীবিত করে তোলার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। গৌড়ীয় নৃত্য আবার তার প্রাণ ফিরে পায়।

dance-2

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...