এই লাইব্রেরীকে ঘিরে নানা ধরনের গল্প শোনা যায়। এই প্রাচীন লাইব্রেরীটির দুর্নাম রয়েছে ভুতুড়ে কার্যকলাপের জন্য। যাঁরা এখানে পড়াশোনা করতে যান তাঁদের অনেকেই বলেছেন, পড়াশোনা করতে করতে আচমকা ঘাড়ে অদৃশ্য কারুর নিঃশ্বাস অনুভব করেছেন। লাইব্রেরীর বল ডান্সের ফ্লোর থেকে ভেসে আসে কনসার্টের সুর। স্তব্ধ দুপুরে শুনেছেন অশরীরী কারুর পদচারণার শব্দ। লাইব্রেরী কর্মচারীদের মতে, লর্ড মেটকাফের স্ত্রীর আত্মাই নাকি এখনও ঘুরঘুর করে এই লাইব্রেরীর অন্দরে বাহিরে। এটি কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরী।
আলিপুরে অবস্থিত এই ভবনটিতে আগে ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের বাস। কিংবদন্তী মতে, আজও তিনি এই ভবনেই বিরাজমান। রাতের বেলা যখন চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঠিক সেই সময়ে অনেকেই তাকে ভবনের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন। আবার দিনের বেলা লাইব্রেরী খুললে বিভিন্ন চেয়ার-টেবিল এদিক-ওদিক হওয়ারও নজির রয়েছে। ঘাড়ে অদৃশ্য কারও নিঃশ্বাস অনুভব করা ছাড়াও কারও মতে, স্তব্ধ দুপুরে শুনেছেন অশরীরী কারুর পদচারণার শব্দ। লাইব্রেরীর কর্মচারীরাও অনেকে অশরীরী সত্তার উপস্থিতি টের পেয়েছেন।
কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় হল, কাউকে আক্রমণ করা হেস্টিংস সাহেবের ভূতের অভিসন্ধি নয়। বরং তিনি নাকি খুঁজে চলেছেন সেই ব্ল্যাক ব্যুরোটি, জীবিতাবস্থায়ও যেটির নাগাল তিনি পাননি। হেস্টিংস বিশ্বাস করতেন, এই ব্ল্যাক ব্যুরোটিই পারবে তাকে হাউজ অভ কমন্সে নির্দোষ প্রমাণ করতে। যদিও শেষ পর্যন্ত তার উপর থেকে সকল অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়েছিল, তবু হেস্টিংসের মন থেকে আজও দূর হয়নি নথিগুলো পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন।
শোনা যায়, ন্যাশনাল লাইব্রেরীর প্রহরীরা নাকি প্রায়ই তাদের সঙ্গে করে হনুমান চালিশা নিয়ে ঘোরেন, যেন হেস্টিংসের ভূত তাদের কোনও ক্ষতি করতে না পারে। কিন্তু এরপরও ভূত দেখার উদাহরণ রয়েছে। তাছাড়া ২০১০ সালে ২৫০ বছরের পুরনো এই ভবনের ভূত-রহস্য আরো ঘনীভূত হয়, যখন হঠাৎ করেই সন্ধান মেলে এমন একটি রহস্যময় কক্ষের, যেটির বিষয়ে ইতিপূর্বে কেউই অবগত ছিল না। এবং আরও কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হল, কক্ষটির কোনো প্রবেশদ্বার নেই। নেই এমনকি কোনও গোপন ট্র্যাপডোরও। তবে কি এই কক্ষেই বাস করেন হেস্টিংস সাহেবের ভূত?
অবশ্য ভূতটি ওয়ারেন হেস্টিংসের না হয়ে অন্য কারুরো হতে পারে। তিনি লর্ড মেটকাফের স্ত্রী লেডি মেটকাফ। অনেকের মতে, তার অতৃপ্ত আত্মাই নাকি ঘুরঘুর করে এই লাইব্রেরীর অন্দরে-বাহিরে। কয়েক বছর আগে এই লাইব্রেরীর সংস্কার কাজ করতে এসে ১২ জন শ্রমিক বেঘোরে প্রাণ হারান। তারপর থেকে ভূতের ভয় আরও বেড়ে গিয়েছে।
কলকাতার দক্ষিণে আলিপুর চিড়িয়াখানার বিপরীতে সুবিশাল অঞ্চল নিয়ে জাতীয় গ্রন্থাগার অবস্থিত ।এই গ্রন্থাগার ভবন ও সংলগ্ন এলাকাটির পোশাকি নাম বেলভেডিয়ার এস্টেট। বেলভেডিয়ার এস্টেট নিজেও একটি হেরিটেজ ভবন এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানান ঐতিহাসিক ও রোমহর্ষক কাহিনী! প্রায় একশো তিরিশ একর জমি নিয়ে তৈরি হয়েছে ভারতের সর্ববৃহৎ ও সরকারি এই গ্রন্থাগারটি।
ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে ঢুকলেই সামনে দেখতে পাবেন একটি পোস্ট অফিস , ডান দিক ধরে সোজা এগোলেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন। বর্তমান এটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অধীনে।
১৮৩৬-এর ২১ মার্চ হেয়ার স্ট্রিট আর স্ট্র্যাণ্ড রোডের সংযোগস্থলে অবস্থিত মেটক্যাফে হলে স্থাপিত হয় কলকাতার প্রথম লাইব্রেরী, যা ‘ক্যালকাটাপাবলিক লাইব্রেরী’ নাম পরিচিত। ১৯৫৩-এর ১ ফেব্রুয়ারি মেটক্যাফে হল থেকে বর্তমানের আলিপুরের বেলভেডিয়ার এস্টেটে স্থানান্তরিত হয়। গ্রন্থগারটিএখন পুরোনো বিল্ডিংটি ছেড়ে ভাষা ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছে। বর্তমানে এই গ্রন্থাগারের সম্পত্তি ২৬,৪১,৬১৫ টি বই, ৮৮,১৬২ টি ম্যাপ, ৩,২৩১ টি পুঁথিও পাণ্ডলিপি, ১,৪৭,৩৩১ টি সাময়িক পত্রপত্রিকা, অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত যাবতীয় বিখ্যাত দৈনিক সংবাদপত্রের প্রতিদিনের সংস্করণ, ২১,২৫০ টি ডিজিটাইজড্ বই ও অন্যান্য দুষ্প্রাপ্য নথি।
এছাড়া বহু প্রাচীন নথি মাইক্রো ফিল্মিংয়ের মাধ্যমে সংরক্ষিত আছে। ভাষা ভবনের মেন রিডিং হলে এক সঙ্গে বসতে পারেন ৫৫০ জন!
জাতীয় গ্রন্থাগার ভারত সরকারের একমাত্র প্রতিষ্ঠন যা খোলা থাকে বছরের ৩৬২ দিন। শুধুমাত্র প্রজাতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও গান্ধী জয়ন্তীতে বন্ধ থাকে জাতীয় গ্রন্থাগারের দরজা।
ন্যাশনাল লাইব্রেরীর টাইমিং
সোমবার থেকে শুক্রবার সকাল ৯ টা থেকে রাত ৮ পর্যন্ত
শনিবার আর রবিবার সকাল ৯.৩০টা থেকে রাত ৬ পর্যন্ত
ন্যাশনাল লাইব্রেরী তে দু ধরণের কার্ড করার ব্যবস্থা আছে টেম্পোরারি ও পার্মানেন্ট। পার্মানেন্ট কার্ড টি করতে হলে ফর্ম পূরণ রে কাউন্সিলর/গেজেটেড অফিসার প্রমুখের সাক্ষর আবশ্যিক। আর টেম্পোরারি কার্ডের আয়ু একদিন। এই কার্ড করাতে হলে একটি পরিচয়পত্রই যথেষ্ট।
সকাল ৮ টা থেকে রাত ৯ টা অবধি সমস্ত ধরণের বই পড়ার সুযোগ পাবেন। ভাষা ভবন এর রিসেপশন এ গেলেই এই সম্পর্কে আপনি সব তথ্য পাবেন প্রসঙ্গত বলে রাখি জাতীয় গ্রন্থাগারে ঢুকতে গেলে একটি পরিচয় পত্র অবশই নিয়ে আসতে হবে। ভাষা ভবন এর ভিতরে কোনো printed copy বা xerox copy allowed নয়। ভিতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। ব্যাগ লাগেজ কাউন্টার এ রাখতে হবে। ফোন সাইলেন্ট মোড এ রাখতে হবে।
কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরী মিউজিয়াম
জাতীয় গ্রন্থাগারের পুরনো বিল্ডিংটি সাজিয়ে একটি অডিও ভিজ্যুয়াল মিউজিয়াম তৈরি করা হয়েছে। মিউজিয়ামটি দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশটিতে অনেক পুরনো স্টোন ভাস্কর্য ও ছবি আছে এবং দ্বিতীয় অংশ যেটি আগে বলরুম ছিল সেখানে এখন অডিও ভিজ্যুয়াল মিউজিয়াম হয়েছে।
এই মিউজিয়াম সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ তা অবধি খোলা থাকে। সোমবার বন্ধ।
ন্যাশনাল লাইব্রেরী ক্যান্টিন
ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে দুটি ক্যান্টিন আছে। একটি ভাষা ভবনের বাইরে আর অন্যটি মিউজিয়ামের পাশে। এখানে চা কফি স্ন্যাক্স সবসময়ই পাওয়া যায়। চা-এর দাম ১ টাকা। অর্ডার দিলে দুপুরের খাবার ও পাওয়া যায় ক্যান্টিন ৯ টা থেকে ৬ টা অবধি খোলা থাকে।