নিঃঝুম রাত। খসখস করে পাতা ঝরে পড়ছে প্রান্তরে। কী যেন একট সড়সড় করে চলে গেল বড় গাছ ছাড়িয়ে মূল বাড়িটার দিকে। মেঘের ফাঁক দিয়ে কখনও চাঁদ বেরিয়ে এসে আলোতে ধুয়ে দিচ্ছে বিশাল চত্বর। কখনও বড় অন্ধকার। টুকরো মেঘ ঢেকে দিচ্ছে আলো। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। চুপচাপ। কিসের যেন অপেক্ষায়...সময় গুণছে। একটা শব্দ,। ঘড়ঘড়,ঘড়ঘড় যেন ভারি চাকা উড়ে আসছে ঝড়ের গতিতে। খানিকক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল একটা বিরাট জুড়ি গাড়ি প্রায় হাওয়ার গতিতে আসছে। মনেই হচ্ছে না ঘোড়ার চাকা মাটি ছুঁচ্ছে। দেখতে দেখতে বিশাল গাড়িটা এসে পড়ল বাড়ির সামনে। চালকহীন গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে পড়লেন একজন। মেঘ সরে গিয়েছে তখন চাঁদের গা থেকে। মাটিতে কোনও ছায়া পড়ল না লোকটার। ত্রস্ত পায়ে ঢুকে গেলেন বাড়িটার মধ্যে। ছায়াহীন কায়াহীন একটা মূর্তি ঘরের পর ঘর পাগলের মত খুঁজে বেড়াত লাগল। বড় জরুরি একটা জিনিস ফেলে গেছেন তিনি। কালো রংয়ের একট ডেস্ক।
যার মধ্যে স্ত্রীকে লেখা কিছু চিঠি ছিল আর ছিল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি। এদেশে লোকটির বিভিন্ন কাজের তথ্য প্রমাণ। যার খবর একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। অন্য কারও হাতে পড়ে সর্বনাশ। দেশ ছেড়ে ইংলণ্ড যাওয়ার সময় হারিয়ে গিয়েছে। বড় প্রিয় ডেস্ক। বড় গোপনীয়ও। প্রায়ই আসেন তিনি। পাগলের মত খোঁজাখুঁজি করেন। পান না। খুব অসহায় লাগে তখন তাকে। খোঁজা শেষ করে ফের গাড়িতে লাফ দিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শূন্যে মিলিয়ে যায় ঘোড়াগুলি, গাড়িটি। নিকষ রাতে ঠকাঠক ঠকাঠক আওয়াজে মিলিয়ে যায় ঘোড়ার খুড়ের শব্দ। তিনি জানেন, তিনি আসবেন। ফের আসবেন। তাকে আবার আসতে হবে। ওই ডেস্কটি না পওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই। ১৮১৮ এ মারা গেছেন। এত বছর ধরে আসেন... প্রায়ই আসেন.... তিনি ওয়ারেন হেস্টিংস।
কলকাতার হেস্টিংস হাউস ঘিরে এমন নানা গল্প রয়েছে। আলিপুর জাজেস রোড-এর কাছে এই বিল্ডিংটি এখন 'ইনস্টিটিউট অফ এডুকেশন ফর ওম্যান'। ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭৪ এ বাংলার গভর্নর জেনরল হন। ১০ বছর নিজ পদে থাকার পর ইস্তফা দিয়ে তিনি ইংলণ্ডে ফিরে যান। দেশে ফেরার পর ঘুষ নেওয়া ব্ল্যাকমেল করা সহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। সাত বছর আইনি লড়াইয়ের পর তিনি মুক্ত হন। কলকাতার হেস্টিংস হাউস বলে পরিচিত এই বাড়ি থেকেই দেশে ফেরেন তিনি। কলকাতার অন্যতম ভূতুড়ে বাড়ি বলে পরিচিত এই বাড়িটি নিয়ে বহু গল্প প্রচলিত আছে। গল্পগুলি কিন্তু আজকের নয়। ১৮৮৪ তে পল বার্ড নামে এক ব্যক্তিও নাকি ওয়ারেন হেস্টিংসর ঘোড়ার গাড়ি দেখেছিলেন।
শুধু ওয়ারেন হেস্টিংসই নন তার পরবর্তীকালেও এই বাড়িতে যাঁরা থেকেছেন তারাও নাকি এই বাড়ির টানে ফিরে ফিরে এসেছেন। স্ট্রিট লাইটের হাল্কা আলোতেও দেখা যায় একটা সাদা ঘোড়া রেশমের মত লেজ দুলিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে চত্বরে। ১৮৩২ নাগাদ এক ঘোড়া পাগল জকি থাকত এই বাড়িতে। তার সব থেকে পছন্দের ঘোড়াকে কেউ গুলি করে মেরে ফেলে। ঘোড়ার শোকে পাগল হয়ে যান ব্যক্তিটি। তার প্রিয় ঘোড়া আজও মাঝে মধ্যেই নাকি ছুটে আসে মালিকের কাছে। যে মালিক মরেও শান্তি পায় নি তার ঘোড়ার জন্য।
অথবা সেই বাচ্চাটা। যে কিনা বহুদিন আগে এক ধূসর বিকেলে তার বন্ধুদের সাথে খেলতে বেড়িয়েছিল। হঠাৎ সজোরে এসে বলটা তার বুকে লাগে। সেখানেই লুটিয়ে পড়ে বাচ্চাটি। বন্ধুরা ভয়ে তাকে ফেলে পালিয়ে যায়। মৃত্যুর আগে সাহায্যের জন্য হাত ছটফট করেও কাউকে পায় নি সে। সেও নাকি আসে...
এখন ছাত্রছাত্রীদের খিলখিলে হাসি, গল্প, ভারি প্রাণবন্ত। গেটে যিনি বসেন তিনি ও অনেককে বলেছেন দিনের বেলা তো দেখিনি। তবে বাকি ঘটনা অনেকেই জানেন। সহজে বলতে চান না। গভীর রাতে বাড়িটার করিডর জুড়ে রিনেরিনে গলায় হেসে চলছে মহিলারা। এই আসরের মধ্যমনি ওয়ারেন হেস্টিংসের স্ত্রী, বিলাসবহুল জীবনযাত্রার জন্য যার খ্যাতি অথবা কুখ্যাতির সীমা ছিল না। উল্কার বেগে প্রিয় মনিবের সঙ্গে দেখা করতে ছুটে আসা একটা সাদা ঘোড়া। আর সেই বাচ্চাটা। যে বল নিয়ে আজও অপেক্ষা করে থাকে কখন তার বন্ধুরা খেলতে আসবে...তাকে ডাকবে....!!