কলকাতার পুরনো ভুতুড়ে বাড়ির মধ্যে এক নম্বর গার্স্টিন প্লেস এবং দ্বিতীয় এর প্রথম অফিস। আকাশবাণীর পুরনো দফতর গার্স্টিন প্লেসে বারবার দেখা গিয়েছে অশরীরী আত্মা। ফাঁকা লম্বা করিডর, অজস্র স্টুডিয়ো আর ব্রিটিশ অবকাঠামো মিলিয়ে আকাশবাণীর ভূতুড়ে অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। রাত গভীর হলে অনেকেই দেখেছেন সাহেবের ছায়া উবু হয়ে কাজ করছে। আবার কেউ কেউ দেখেন মধ্যরাতে রেকর্ডিং রুমের বারান্দায় কে যেন গান শুনছেন। হয়তো বেতারের আশ্চর্য বিজ্ঞানী সে যুগের মনে জন্ম দিয়েছিল এসব ভূতুড়ে বিশ্বাসের। এখনও নানা স্টুডিও থেকেই রাতে ভেসে আসে যান্ত্রিক সুর। বলাই বাহুল্য, সেই যন্ত্রগুলো কোনও মানুষ বাজায় না।
১, গার্স্টিন প্লেস বললেই যেমন কলকাতার রেডিয়োর প্রথম অফিস তেমনই কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভূতের গল্প। কারন এর পিছনেই রয়েছে সেন্ট জন্স চার্চ। সেখানে রয়েছে জোব চার্নকের কবর, লেডি ক্যানিংয়ের কবর থেকে শুরু করে কুখ্যাত অন্ধকূপ হত্যার স্মৃতি। আবার রয়েছে রোহিলা যুদ্ধের স্তম্ভও। আর ওই অঞ্চলের পাশের অংশটি ছিল কবরস্থান। এমন এক স্থানের সঙ্গে ভূতের গল্প সহজেই জড়িয়ে যাবে তা স্বাভাবিক কিন্তু আজকের সেই স্থানকে দেখলে বোঝা দায়। বিশ্বাস করবেন না যে এই বাড়ির তিন তোলার অফিস ঘরে নাকি এখনও পিয়ানোর শব্দ শোনা যায়। কে বর্তমানে এই শব্দ শুনেছে তা জানা যায় না কিন্তু এ সব কথা চলেই আসে।
এসব তত্বে সঙ্গত দেয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নিজস্ব অভিজ্ঞতা। তিনি আমাদের কাছে শুধুমাত্র মহালয়ার সকালের জন্য বিখ্যাত হয়ে থাকলেও ,মানুষটি আদ্যপ্যান্ত রেডিয়োপ্রেমী মানুষ ছিলেন। তাঁকেও নাকি বহুবার দেখা দিয়েছিল ১ নম্বর, গার্স্টিন প্লেসের ভূত। তিনি নিজেই বলেছিলেন 'ও বাড়ি ভূতুড়ে'। ১৯২৭ সালের ২৪ শে আগস্ট , কলকাতা বেতার স্টেশন ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানী ১ নং গার্স্টিন প্লেসের এই বাড়িতেই প্রথম বেতার স্টেশন গড়ে তোলে । গোড়া থেকেই বাড়িটির বিশেষ সুনাম ছিল না ।
'অল ইন্ডিয়া রেডিও’, যার বর্তমান অফিসটি অবশ্য ইডেন গার্ডেন্সে। তবে গোড়ার দিকে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র অফিসটি ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত গার্স্টিন প্লেসের ওই বাড়িতেই অবস্থিত ছিল। একবার ভদ্রবাবু অনেক রাত পর্যন্ত তিন তলার অফিসে বসে ফাইলপত্র ঘাঁটছিলেন। পরে কাজ শেষ হলে তিনি যখন প্রায় নীচে চলে এসেছেন, তার মনে হয়, যে ফাইলটা তিনি দেখছিলেন সেটা নিয়ে আরেকবার নিয়ে আসবেন। তিনি স্টুডিওর বেয়ারা মেহেরবানকে পাঠান সেই ফাইলটি আনতে। সে তিন তলায় উঠেই কিছুক্ষন বাদে হাঁফাতে হাঁফাতে ফিরে আসে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র তাঁকে ওভাবে নীচে নেমে আসতে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ঘটনা কী?
মেহেরবান বলেছিলেন, তিনতলায় ঘরে সে এক সাহেবকে ঝুঁকে পড়ে টেবিলে রাখা ফাইলপত্তর ঘাঁটতে দেখেছে। সে নাকি ভূতের তাড়াও খেয়েছে বলে জানিয়েছিল। ভূত তাঁর গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়েছিল। এসব শুনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর সাহস দেখাননি। শুধু তিনি একাই নন সেই সময় আরও অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন সেই সাহেব ভূতকে। তিনি নাকি তাদের বেশ উৎপাত করতেন। ফাইলপত্তর ফেলে দেওয়া থেকে শুরু করে, মাইক্রোফোন ধরে আচমকা টানাটানি সবরকম উৎপাত চলত।
১৯৫৮ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও সেখান থেকে সরে যাবার পর বাড়িটি আজও ভূতুড়ে হানাবাড়ি হিসাবেই পরিচিত। বর্তমানে সেটি একটি অফিস বাড়ি। বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীদের কথায়, ইতিহাসের কোনও কিছু না থাকলেও রয়ে গিয়েছে বাড়ির ভূত বাংলো তকমা, কিন্তু ভূত বলে এখানে আর কিছু নেই। ভূত যদি থাকে তাহলে এই দেওয়ালে ওপারে রয়েছে। এই জমজমাটের মধ্যে ওনারাও আসতে চাইবেন না।
ভূত তত্বের সঙ্গে আরও যোগ রয়েছে ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসে বেতার কেন্দ্রের। জনশ্রুতি অনুযায়ী, বাড়ি তৈরির আগে ওই জায়গায় ছিল এক পুরনো কবরখানা। কোম্পানি-শাসনের গোড়ার দিকের কথা। এখানকার জলহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে যে সব ইংরেজ কর্মচারী মারা যেতেন, তাঁদের সমাধিস্থ করা হতে এই গোরস্থানে।