বাউলমনের রামকিঙ্কর

ছোটবেলা থেকেই বড় ইচ্ছে ছিল, ‘যেখান দিয়ে যাব, রাস্তার ধারে ধারে মূর্তি রচনা করে চলব’। তাঁর কথায়-'সূর্যের আলো, চাঁদের আলো আর বর্ষাতুর আকাশের তলায় বড় মূর্তি দেখতে ভালো লাগে।'

ছোট থেকেই তিনি ডানপিটে, খামখেয়ালী পাগলাটে গোছের। নিজেই নিজের পদবী পরিবর্তন করে রেখেছিলেন ‘বেইজ’‘বেইজ’ পদবীটি বৈদ্য পদবীটির পরিবর্তিত রূপ। ছোটবেলায় কুমোড়দের পাড়ায় ঘুরে ঘুরে তিনি মূর্তি বানানো দেখে খেলার ছলেই মূর্তি গড়তে শুরু করেন। পড়াশুনার দিকে ঝোঁক ছিল না কোনদিন, শিল্পের গড়ন তার কাঠামো, তুলির আঁচড় বড্ড বেশি করে টানত। এই প্রবল টান তাঁকে গড়ে দিয়েছিল এক আত্মমগ্ন শিল্পী হিসেবে। তিনি রামকিঙ্কর বেইজ।

জীবন আর ছবিকে এক করে ফেলেছিলেন। প্রচন্ড দারিদ্র্য মাথা ঝুঁকিয়েছিল তাঁর শিল্পী সত্ত্বার কাছে। অভাবকেই তিনি স্বভাবে পরিণত করলেন, শিল্পকে নিয়ে নিলেন নিজের অন্তরে।

একটা ছবি আঁকতে চাই রঙ, তুলি কাগজ আরও কতরকম কি। পিতা পেশায় ক্ষৌরকার, কতই বা সাধ্য যে, ছেলেকে রঙ তুলি কিনে এনে দেবেন, তাই কিশোর রামকিঙ্কর তার শিল্পতৃষ্ণা মেটানোর জন্য শিম গাছের পাতা, মেয়েদের পায়ের আলতা, কাচা হলুদ বাটা, মুড়ি ভাজার ভুষোকালি এমনকি পুঁইশাক থেকে বেগুনি রঙের নির্যাস বের করে তাই দিয়ে সাদা কাগজে ছবি হিসেবে ফুটিয়ে তুলতেন মনে কল্পনাকে। ছাগলের লোম কেটে বাঁশের কাঠির ডগায় বেঁধে তুলি বানিয়ে চলত রঙ বহর।

সেই সময়েই জাতীয় কংগ্রেসের পোস্টার এঁকেছিলেন তেলরঙে, যা তাঁকে শিল্পের প্রতি আরো নিবিষ্ট করতে সাহায্য করেছিল। নিজের দেশে পরাধীন হয়ে থাকার যন্ত্রণা, বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ আর আত্মদান এবং নিজের ভেতরকার শিল্পীসত্ত্বার হাহাকার- এসবই মনকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল বারবার, তাই বাধ্য হয়েছিলেন প্রতিবাদ করতে। তুলির আঁচড় টেনে সমাজের খোলনোলচে বদলে দেওয়া যায় কি না? সেই ভাবনা ঘুরত মাথায়। সেই কিশোর বয়সেই। শিল্পীসত্ত্বা কি আর বয়সের ফারাক মেনেছে কখনও। ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুললেন আন্দোলনের না-বলা আর অদেখা মুহূর্তগুলো, রং চাপিয়ে ক্যানভাসে দিলেন আন্দোলনের অব্যক্ত স্লোগান,  বিপ্লবীদের পোর্ট্রেট করলেন। যেন এক শিল্পিত মনের জ্বলন্ত প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদী একরোখা ছেলেটিকে মনে ধরে গেল রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের। যুগীপাড়ার রাস্তা থেকে তুলে এনে 'প্রবাসী' পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চ্যাটার্জী রামকিঙ্করকে দাঁড় করালেন রবি ঠাকুরের সামনে।

এক শিল্প পাগল মানুষকে দেখলেন এক শিল্প সাধক। সালটা ১৯২৫, তখন রামকিঙ্করের বয়স উনিশ। প্রথম যৌবনের দুরন্ত উন্মাদনায় ভরপুর। সেখান থেকেই শুরু, জীবনের শেষ পর্যন্ত আর এখান থেকে নড়েননি। শান্তিনিকেতনে এখনও রামকিঙ্কর বেইজ এর সবচেয় বিখ্যাত দুই ভাষ্কর্য কীর্তি 'সাঁওতাল পরিবার' এবং 'কলের বাঁশি' এখনও কলাভবনের ঐতিহ্যের স্বাক্ষর রাখে । রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনকে শিল্পকলায় ভরিয়ে তোলার ভার দিয়েছিলেন তাঁর যোগ্য শিষ্য রামকিঙ্করকে, সেই নির্দেশের মর্যাদা তিনি রেখেছিলেন। শান্তিনিকেতনের নানা প্রান্তে 'সুজাতা', 'গৌতম বুদ্ধ', 'সাঁওতাল পরিবার' এবং 'কলের বাঁশি' সহ বিভিন্ন মূর্তি তৈরী করেছিলেন। যা এখনও বর্তমান।

এই বিষয়ে লেখক সাগরময় ঘোষাল লিখছেন রবীন্দ্রনাথ রামকিঙ্করকে ডেকে বলেছিলেন, ‘শোন, কাছে আয়। তুই তোর মূর্তি আর ভাস্কর্য দিয়ে আমাদের সবখানে ভরে দে। একটা শেষ করবি আর সামনে এগিয়ে যাবি- সামনে’

প্রথমে বাঁশের ফ্রেমে খড় দিয়ে মোটা করে সিমেন্ট লেপে তৈরি করেছিলেন 'সাঁওতাল পরিবার'। ভার কাঁধে মাঝি, ভারের এক দিকে মালপত্র আর অন্য দিকে ছোট ছেলে, পাশে ঝুড়ি মাথায় মেঝেন। কিন্তু বাঁশের ফ্রেমে সিমেন্ট টেকে না, ভেঙে পড়েছিল। তার পর তৈরি করিয়েছিলেন লোহার আর্মেচার। তখনও শান্তিনিকেতনে বিদ্যুৎ নেই, সন্ধ্যার পর তাঁবু ফেলে মূর্তির সামনে বসে থাকতেন শিল্পী। ক্ষুধাতৃষ্ণার বোধ নেই, কখনও নিজের কাজ ভাঙতেন, কখনও বাড়তি কংক্রিট চেঁচে দিতেন।

নিজেই বলেছেন, "উপোসটুপোসও মনে থাকে না কাজের মধ্যে ঢুকে পড়লে। ওটাই কেল্লা হে। কেউ ছুঁতে পারবে না তোমাকে এই কেল্লায় একবার সেঁধিয়ে পড়তে যদি পারো। যতই চেল্লাক, কানে যাবে না কিছু। ওখানে শুধু কাজ আছে আর তুমি আছো।" শান্তিনিকেতনে তার 'ফাউন্টেন' শিরোনামে ফোয়ারাসদৃশ একটি ভাস্কর্য আছে। এটি মূলত একটি পদ্মপুকুরে দুটো মহিষের সম্মিলিত রূপ। মহিষের লেজ দুটো এমনভাবে নড়ছে যেন জীবন্ত দুটি মাছ। একটি প্রাণীর ফর্মকে রামকিঙ্কর দুটি প্রাণীর সম্মিলিত রূপে সাজিয়েছেন। আবার একইসঙ্গে কাজটিতে একটি ঝর্ণাও শোভা পাচ্ছে। তিনি নাকি গ্রীষ্মের দুপুরে এক মহিষকে স্নান করতে দেখেছিলেন। তখন স্নানের ধারা ছিটানোর সময় মহিষের লেজকে মাছ বলে মনে হচ্ছিল।

সেখান থেকেই ভাবনা বসল মাথায়। আর শুরু হল তার আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে এক নতুন শিল্পকলা। নিজের চোখে দেখা একদম সাধারণ আর নিত্যদিনকার জীবনটাকেই পাশ্চাত্যের ধাঁচে মিশিয়ে ভাস্কর্য গড়ার ওস্তাদ ছিলেন এই গুণী শিল্পী।শান্তিনিকেতনে তিনিই প্রথম তেলরঙের চিত্রকর্মের কাজ শুরু করেছিলেন। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা আর বিতর্কেরও শেষ ছিল না। প্রথম প্রথম তো তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক নন্দলাল বসুও আপত্তি করেছিলেন। পরে তাঁর কাজ আর কাজের ধরন দেখে আর কিছু বলতে পারেন নি। নন্দলাল বসু সবসময় তাঁকে বলতেন, ‘রাতের স্বপ্নগুলোকে মনে রেখো কিঙ্কর। ভুলে যেও না। তেমন হলে, স্বপ্ন ভেঙে গেলে, উঠে স্বপ্নের কথা লিখে রাখবে। কোনও স্বপ্নই ভুলে যেও না। স্বপ্নে ছবি আসে কিঙ্কর, প্রতিমা আসে। স্বপ্ন আঁকবে!’

তিনি গুরুর কথাই অনুসরণ করে ছিলেন। সেই স্বপ্ন আঁকাটায় তার জীবনের একমাত্র স্বপ্ন হয়ে উঠেছিল।            

বর্তমানে দিল্লীর রিজার্ভ ব্যাংকের সামনে তার একটি ভাস্কর্য আছে 'যক্ষ-যক্ষী' নামে। পাথরে গড়া এ ভাস্কর্যের প্রতীকটা আসলে পৌরাণিকতার সঙ্গে ব্যাংকের একটা সাদৃশ্য স্থাপন করে। যক্ষের এক হাতে একটা পিনিয়ন- ইন্ডাস্ট্রির প্রতীক আর অন্যহাতে মানিব্যাগ, ব্যাংকের প্রতীক। যক্ষীর এক হাতে ফুল, আর অন্য হাতে ধানের শীষ- কৃষিপণ্য আর সাফল্যের প্রতীক। দিল্লিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে আজও দাঁড়িয়ে আছে রামকিঙ্করের তৈরি করা ২১ ফুটের যক্ষ-যক্ষীর মূর্তি। ১৯৫৪ সালে কুলু যাওয়ার পথে রামকিঙ্কর দেখেছিলেন তাঁর পছন্দসই পাহাড়। ভাকরা-নাঙ্গাল বাঁধের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে তা ব্লাস্ট করিয়ে পাওয়া গেল পাথরের খণ্ড। ন্যারোগেজ লাইনের ট্রেনে সেই পাথর আনার জন্য বদলানো হয়েছিল ওয়াগনের চেহারা। পাঠানকোটে হয়ে ব্রডগেজ ট্রেনে সেই পাথর আনা হল দিল্লিতে। এত ঝঞ্ঝাট করে পাথর আনা হল, কিন্তু কাজ আর এগোয় না। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তাঁকে সতর্ক করে বার্তা পাঠাল, নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। শিল্পীর কানে গেল সেই কথা।

তিনি বললেন প্রফেশনাল শিল্পীর মত ওইভাবে সময় বেঁধে দিয়ে কাজ করতে পারবে না। রামকিঙ্কর মানেই স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিসুখে মগ্ন এক উদাসীন শিল্পী। এই উদাসীনতা কৃত্রিম সভ্যতাকে হেলায় প্রত্যাখ্যান-করা এক বাউলমনের। এক বার বিড়ি কেনার জন্য দু'টাকার  দরকার, কিন্তু সেই টাকাও তাঁর কাছে ছিল না। সোমেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় বিছানার শতরঞ্চি উল্টে দেখতে পেয়েছিলেন, সেখানে পড়ে আছে একটা মোটা অঙ্কের চেক। কবে যে তা এক্সপেয়ার করে গেছে শিল্পীর সে খেয়াল নেই। খাওয়ার সময় তাঁর পাতেই মুখ দিত বিড়াল, কুকুরেরা। রামকিঙ্কর তাদের তাড়িয়ে দিতেন না, উল্টে সস্নেহ বলতেন, 'খা, খা, তোদেরও তো বাঁচতে হবে।' এই অগোছালো খ্যাপামি তাঁর জীবন।

শিল্পের সাথে সাথে জীবনে জীবনে অনেক নারী এসেছে, এটা সত্যি। সেই নিয়ে তার ছিল নির্লিপ্ত আচরণ। তাঁর কথায়-"কেউ এসেছে দেহ নিয়ে, কেউ এসেছে মানসিক তীব্র আকর্ষণ নিয়ে। কিন্তু ছাড়িনি কাউকে। ধরেছি, আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছি। হজম করে ছিবড়ে করে ছেড়েছি। হজম করার মানে জানো? ও মন্ত্রটা আমার গুরুদেবের কাছে শেখা। তাঁর থেকে জন্ম নিয়েছে আমার অনেক ছবি, মূর্তি, অনেক কল্পনা, আর অনুভব। আমার মডেলরা আমার বহু স্কেচে, ছবিতে, মূর্তিতে, বেঁচে আছে। মডেলরা তো এভাবেই বেঁচে থাকে।" রামকিঙ্কর নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে এমন একজন শিল্পী- স্রষ্টার ছবি ভেসে উঠে। যিনি সবদিক থেকে অন্যরকম। ব্যতিক্রমী।

যিনি বিশ্বাস করতেন ফুল ফোটানোর কাজে লেগে আছে এই মাটি, আকাশ, ষড়ঋতু আর সূর্যালোক, সেই ফুল হয়তো শুকিয়ে যাবে একসময়। কিন্তু ফুলের এই ফুটে ওঠা আর ঝরে যাওয়ার মধ্যে লাভ-লোভ-ক্ষতির হিসাব থাকে না কোনও। গভীর অরণ্যের মধ্যে কেউ দেখুক অথবা না দেখুক এই ফুটে ওঠাই তার কাজ, তার সার্থকতা। নিজের সৃষ্টি ও জীবনকে এরকমই এক নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখেছিলেন রামকিঙ্কর। আর সেখানেই তার সার্থকতা। সেখানেই তিনি আজও জীবন্ত হয়ে উঠেন, তাঁর শিল্পের রঙ মহলে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...