বাংলা নাট্যজগৎ এর বহু রত্নের মধ্যে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। ১৮৫০ সনের ২৫ শে জানুয়ারি বাগবাজারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিরালী ব্রাহ্মণ কূলে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। পাথুরিঘাটা ঠাকুরবাড়ির বৌমা শিবসুন্দরী ছিলেন তার নিজের বড় পিসিমা। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে মুস্তাফিদের পরিবারের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। ছোটবেলা থেকেই তার মন শুধু টানতো পাথুরিঘাটা ঠাকুরবাড়ির লাইব্রেরির বইগুলির দিকে। আর ছোটো বেলায় তিনি নিখুঁত অনুকরণ করার খেলা খেলতেন। কাউকে একবার চোখে দেখে নিলে তার চলা, বলা, হাঁটা, আদব, কায়দা সব কিছু নিখুঁত অনুকরণ করতে পারতেন। ছোট থেকেই অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা তাঁর মধ্যে গঠিত হয়েছিল।
৩০ শে ডিসেম্বর ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর নাটকটি মঞ্চে অভিনীত হয়। এই নাটকটি অর্ধেন্দুর দেখা প্রথম নাটক। নাটকটি দেখে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে সালের ২ রা নভেম্বর হেমেন্দ্র নাথের জোড়াসাঁকোর কয়লাহাঁটার বাড়িতে প্রথম অভিনীত হয় কিছু কিছু বুঝি নাটকটি। এই নাটকটিতে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। 'কিছু কিছু বুঝি' নাটকটি অর্ধেন্দু কে খ্যাতি দিল। ১৮৬৭ সালে বাগবাজারের অ্যামেচার থিয়েটার প্রতিষ্টা করা হয়। তারা প্রথম নাটক নির্বাচন করেন দীনবন্ধু মিত্রের সধবার একাদশী। পূর্বে কিছু কিছু বুঝি নাটকের দেখে নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অর্ধেন্দু কে নিয়ে আসেন এই দলে। কিন্তু তখন সমস্ত চরিত্রের নির্বাচন সম্পূর্ণ হয়ে গেছিল। অর্ধেন্দুর আর এই দলে অভিনয় করা হয়ে উঠলো না। কিন্তু কিছুদিন মহড়া করার পরে বোঝা গেল গিরিশচন্দ্রের নিমাই আর নগেন্দ্রনাথের অটল চরিত্র ছাড়া কোনো চরিত্র তেমন ভালো হচ্ছে না। আবার অর্ধেন্দুর ডাক পড়ে। তাকে দেওয়া হল কেনারা চরিত্র। শুধু নিজের চরিত্রই নয় ছোট ছোট চরিত্র গুলিকে ও তিনি ঘষে মেজে ঠিক করে দেন। নাটক মঞ্চে অভিনীত হয়। চতুর্থ রজনীতে তিনি জীবনচন্দ্রের চরিত্রে অভিনয় করেন। দীনবন্ধু মিত্র স্বয়ং তার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে অনেক প্রশংসা করেন।
এরপর দীনবন্ধু মিত্রের ‘বিয়ে পাগল বুড়ো’ নাটকে অর্ধেন্দু মুখ্য চরিত্র রাজীব মুখুয্যের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তিনি এই নাটকে ও অভিনয়ে মঞ্চ মাত করে দেন। অর্থনৈতিক দূরবস্থার কারনে দীর্ঘ দেড় বছর তিনি নাট্য জগৎ থেকে বিরতি নেন। কিন্তু অভিনয় ছাড়া তিনি থাকতে পারেননি। তিনি যাত্রার সঙ্গে যুক্ত হলেন খুলে ফেললেন কনসার্টের দল। উষা, অনিরুদ্ধ, শকুন্তলা, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, সীতার বনবাস প্রভৃতি যাত্রার সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু নাট্যমঞ্চ তাকে যেন ডাকে। মাঝে মাঝেই একত্রিত হন নাটক করার জন্য। অবশেষে দীনবন্ধু মিত্রের লীলাবতী নাটকটি কে নির্বাচন করেন। কিছু টাকার অভাবে নাটকটি করা সম্ভব হচ্ছিল না। পরবর্তী কালে টিকিট বিক্রয় করে অর্থ জোগাড় করা হবে। এই কথা মাথায় রেখেই নাটকের মহড়া চালু করা হল। নগেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের বাড়িতে প্রথম শো করা হল। এবং নাটকটি খুবই প্রশংসা পেল। নাট্য জীবনে তিনি বিভিন্ন পর্বে ন্যাশনাল, ষ্টার, অরোরা, মিনার্ভা প্রভৃতি থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিনোদিনীর প্রথম অভিনয় শিক্ষক তিনিই ছিলেন। বাংলা নাট্য মঞ্চের বহু অভিনেতা, অভিনেত্রী তার কাছে অভিনয় শেখেন। হাস্যরসাত্মক চরিত্র থেকে শুরু করে গুরুগম্ভীর চরিত্র বা সাহেবের চরিত্রে সব চরিত্রেই তাঁকে দারুন মানাত। তাঁর অভিনীত নাটকগুলি হল 'সধবার একাদশী', 'বিয়ে পাগল বুড়ো', 'লীলাবতী', 'নীলদর্পণ', 'জামাই বারিক', 'নবীন তপস্বিনী', 'নবনাটক', 'শর্মিষ্টা', 'বিধবাবিবাহ নাটক', 'প্রণয় পরীক্ষা', 'মৃণালিনী, কমলেকামিনী', 'হেমলতা, আনন্দকানন', 'বঙ্গের সুখবাসন', 'আনন্দমঠ', 'পলাশীর যুদ্ধ', 'রাজা বসন্ত রায়', 'মেঘনাথ বধ' ইত্যাদি। ১৯০৮ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর পরলোকগমন করেন।