আজ তাঁর গোঁফে তা দেওয়া দেখে তাঁকে গব্বর বলেন। কিন্তু তাঁর এই নামের ইতিহাস অনেক আগের। ডাকাবুকো শিখরের গব্বরগিরি শুরু হয়েছিল অনেক আগেই।
দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার ঢের আগে শিখর ধাওয়ানের এই নামকরণ। ধাওয়ান তখন দিল্লির হয়ে রঞ্জি ট্রফি খেলতেন, অভিষেক হয়নি ভারতের হয়ে। যখন বিপক্ষের কোন লম্বা ব্যাটিং পার্টনারশিপ চলত, সিলি পয়েন্টে দাঁড়িয়ে 'স্লেজিং'-হুঙ্কার ছাড়তেন ব্যাটসম্যানদের লক্ষ্য করে, "বহুত ইয়ারানা লাগতা হ্যায়! (খুব যে দোস্তি দেখছি তোদের!)"
বহুত ইয়ারানা লাগতা হ্যায়! ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে কিংবদন্তি ব্লকবাস্টার 'শোলে'-র সেই ডায়লগ! গব্বর সিং রূপী আমজাদ খানের হাড় হিম করা গলায়, 'জয়' আর 'বীরু'-বেশী অমিতাভ বচ্চন আর ধর্মেন্দ্রর উদ্দেশ্যে। যে সংলাপ আজও মুখে মুখে ফেরে, যে সংলাপ ঢুকে গিয়েছে বলিউডের চিরন্তন লোকগাথায়, সেই ডায়লগ ব্যাটসম্যানদের দিকে ছুড়ে দিতে ভালবাসতেন শিখর ক্লোজ-ইন পজিশনে ফিল্ডিংয়ের সময়। সেই থেকেই টিমমেটরা শিখরকে 'গব্বর' বলে ডাকতে শুরু করেন। নামটা হিট করে যায়। এবং থেকে যায়।
শিখর ধাওয়ান নয়াদিল্লিতে জন্মগ্রহণকারী ভারতের জাতীয় দলের একজন ক্রিকেটার। তিনি মূলত উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতের জার্সি গায়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। বাঁহাতি ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি দলের প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে ডানহাতি অফ ব্রেক বোলিং করেন।
বাইশ গজের বাইরে আরও একটা পরিচিতি রয়েছে শিখর ধাওয়ানের। তিনি ধ্রুপদী সঙ্গীতের অনুরাগী। সেই সঙ্গে বাঁশি বাজানোও শিখছেন। এই প্রসঙ্গে ধাওয়ান বলেন, 'সুফি সঙ্গীতের বড় ভক্ত আমি। ওয়াদালি ব্রাদার্স আমার ফেবারিট। আমি বাঁশি বাজানো শিখছি। উপভোগও করছি। আমার মনে হয়, যখন ম্যাচ থাকে না, প্র্যাকটিস থাকে না তখন যে সময়টা পাই, তখন এসব করি। ইউ টিউবে বাঁশি শোনার পর বাঁশি বাজানো শেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। এতে অনেকটাই চাপমুক্ত থাকা যায়। হোটেলের ঘরে বসে গল্প করার থেকে কিছু একটা শেখা ভালো বলে আমার মনে হয়েছে।'
মাত্র ১২ বছর বয়সে তাঁর চাচা বিখ্যাত কোচ তারক সিনহা এর অধীনে ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য মর্যাদাপূর্ণ সোনাট ক্লাবে ভর্তি করে দেন । তিনি স্কুলের একমাত্র টুর্নামেন্টে অনুর্ধ -১৫ দলের হয়ে শতকের স্কোর করে নিজের প্রশিক্ষককে মুগ্ধ করেছিলেন।
তিনি দিল্লীর পশ্চিম বিহারের সেন্ট মার্কস সিনিয়র সেকেন্ডারি পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা করেন । তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ফোকাস করার জন্য ১২ তম গ্রেড শেষ করার পর তাকে পড়াশোনা বন্ধ করতে হয়েছিল।
২০০৪ সালে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল তার । ন'বছর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার পর টেস্ট দলে সুযোগ পেয়েছিলেন । দীর্ঘ ন'বছর ধরে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি । এখন ছ'বছর ধরে দেশের হয়ে খেলছেন ।
২০০৪ সালে আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের পক্ষে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী ছিলেন ধাওয়ান। ৭টি খেলায় অংশগ্রহণ করে ৩ সেঞ্চুরিসহ ৮৪.১৬ রান গড়ে ৫০৫ রান করে ঐ প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাঁহাতি এই ওপেনারের অভিষেক হয়েছিল ২০১০ সালের অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে।জুন, ২০১১ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সুরেশ রায়নার অধিনায়কত্বে কুইন্স পার্ক ওভালে টুয়েন্টি২০ ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন। অভিষিক্ত পার্থিব প্যাটেলের সঙ্গে জুটি গড়লেও তিনি মাত্র ৫ রান করেন।
১৪ মার্চ, ২০১৩ তারিখে বীরেন্দ্র শেওয়াগের পরিবর্তে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো মাঠে নামেন ধাওয়ান।সাদা পোশাকে অভিষেকের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও দুই বছর। ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে এই ফরম্যাটে অভিষেক হয় তার।
মোহালির পিসিএ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত অজিদের বিপক্ষে তৃতীয় টেস্টে ও নিজের অভিষেক প্রথম ইনিংসে মাত্র ৮৫ বলে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ধাওয়ান। এর মধ্য দিয়ে অভিষেক টেস্টে সবচেয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেন তিনি। এর ফলে তিনি গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের কানপুরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯৬৯ সালে গড়া ১৩৭ রানের দীর্ঘদিনের অক্ষুণ্ন রেকর্ডটি ভেঙ্গে ফেলেন।
ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম কোনো ব্যাটসম্যান হিসেবে শততম ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করার রেকর্ড গড়েন শিখর ধাওয়ান।
১০ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চতুর্থ ওয়ানডেতে ৯৯ বলে সেঞ্চুরি করেন ধাওয়ান। এটি ছিল তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শততম ওয়ানডে ও ১৩তম সেঞ্চুরি। ভারতের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে শততম ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করলেও ক্রিকেট ইতিহাসে নবম ব্যাটসম্যান তিনি।
১৯৮৮ সালে ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম কোনও ক্রিকেটার হিসেবে ক্যারিয়ারের শততম ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করার কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি গর্ডন গ্রিনিজ। শারজাহতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ঐতিহাসিক সেই সেঞ্চুরিটি করেছিলেন তিনি।
২০১৫ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম খেলায় ৭৩ রান সংগ্রহের মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতায় চমৎকারভাবে শুরু করেন। এরপর মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত গ্রুপ-পর্বের দ্বিতীয় খেলায় দক্ষিণ আফ্রিকা দলের বিপক্ষে তিনি তার ২য় ওডিআই শতকসহ ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান তোলেন। তার ১৪৬ বলে ১৩৭ রানের সুবাদে ভারত দল তাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৩০ রানের ব্যবধানে জয়লাভ করে। ১০ মার্চ, ২০১৫ তারিখে হ্যামিল্টনের সেডন পার্কে অনুষ্ঠিত গ্রুপ পর্বের পঞ্চম খেলায় আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ১০০ রান করে দলকে ৮ উইকেটের সহজ জয় এনে দেন এবং ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন।
২০১৫ সালের বিশ্বকাপে দুটি সেঞ্চুরি এবং ২০১৯ এ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে, অর্থাৎ ভারতের দ্বিতীয় ম্যাচে একটা সেঞ্চুরি। সব মিলিয়ে তাঁর বিশ্বকাপ জার্নিতে এখনও অবধি তিনটি সেঞ্চুরি শিখর ধাওয়ানের । বিশ্বকাপে লিটল মাস্টার সচিন তেন্ডুলকর ও রোহিত শর্মার সেঞ্চুরির সংখ্যা ৬টি। সৌরভ গঙ্গোপাধ্য়ায়ের সেঞ্চুরি রয়েছে ৪টি। আর ঠিক তার পরেই আছেন শিখর ধাওয়ান ।
২০০৮ সালে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসে খেলেছিলেন ধাওয়ান। তারপর তিনি দল বদল করে চলে যান মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সে। এরপর সেখান থেকে আসেন ডেকান চার্জার্সে। সবশেষে তার ঠিকানা হয় সানরাইজার্সে।
সানরাইজার্সের হয়ৈ শীর্ষ রান সংগ্রাহক ধাওয়ান। ৯১ ইনিংসে তার রান ২৭৬৮। এভারেজ ৩৫.০৩ এবং স্ট্রাইক রেট ১২৫.১৩। সর্বশেষ আইপিএলে ধাওয়ান ৪৯৭ রান করেছিল।
দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের হয়ে লাগাতার দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি । আইপিএল ইতিহাসে শিখর যে প্রথম প্লেয়ার যিনি লাগাতার দুটি ম্যাচে শতরান করেছেন ।