১৯২৫ সালের ১৫ই জুলাই কলকাতায় জন্ম গ্রহণ করেন বাদল সরকার। স্কুল ও কলেজ জীবনে তার নাম ছিল সুধীন্দ্রনাথ সরকার। কিন্তু কর্ম জীবনে তিনি পরিচিতি লাভ করেন বাদল সরকার নামে। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতকত্ব পাস করে শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন তিনি। পেশাগত দিক থেকে তিনি ছিলেন টাউন প্ল্যানার।
ষাট এর দশকে আধুনিক নাট্যকার হিসাবে মারাঠি ভাষায় বিজয় তেন্ডুলকর, হিন্দি ভাষায় মোহন রাকেশ এবং কানাড়ি ভাষায় গিরিশ কারনাড ঠিক এই সময়ে বাংলাতে নাম উঠে আসে বাদল সরকারের। তিনি প্রায় পঞ্চাশটি নাটক রচনা করেন। ১৯৫১ সালে 'চক্র থিয়েটারের' 'বড় তৃষ্ণা' নাটকে মধ্যে দিয়েই তার রঙ্গ মঞ্চের যাত্রা শুরু। সেই সময়ে বাংলা থিয়েরেটারে শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্তের মত বিখ্যাত নাট্যকাররা মঞ্চ কাঁপিয়ে নাটক নির্মাণ করছে। ১৯৬৩ সালে তিনি তখন নাইজেরিয়াতে সেই সময়ে তিনি তার নাট্য জীবনের সর্বশ্রেষ্ট নাটক এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকটি লিখে ফেলেন। যা ১৯৬৫ সালে প্রথম কলকাতায় মঞ্চস্থ করা হয়। এর মধ্যেই তিনি 'শতাব্দী’ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ভাবে নাটকে ওপর আলোচনা, পড়াশোনো এবং রিহার্সাল করে যান। কিন্তু তিনি বাংলা নাট্য জগৎ এ পরিচিতি লাভ করেন ১৯৭০ সালে। তাকে শিক্ষা মূলক এবং সামাজিক নাট্যকার রূপে গণ্য করা হয়। তাঁর নিজের তৈরী থার্ড থিয়েটারও তার কঠিন প্রচেষ্টার ফল। ল্যাটিন আমেরিকার তৃতীয় চলচ্চিত্রের আদলেই বাদল সরকার গড়ে তুলেছিলেন তার থার্ড থিয়েটার। কিন্তু বাদল সরকারের তৃতীয় থিয়েটার গড়ে উঠেছিল দেশীয় ভাবধারায়। বাদল সরকারের নাটকে ছিল না কোন প্লট, ছিল না কোন চরিত্রের চরিত্রায়ন, অভিনেতা অভিনেত্রীর ছিল সেই স্বাধীনতা যার ফলে তাঁরা নিজেরা নিজেদের চরিত্র নির্বাচন করতে পারতো। এমনকি দর্শকেরাও অভিনয়ে অংশগ্রহন করতে পারতো। তাঁর থার্ড থিয়েটারে মুখের অভিব্যক্তি থেকে শারীরিক অভিব্যক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাদল সরকারের নাটকের চরিত্রদের স্পেসের স্বাধীনতা ছিল প্রচুর। মনিপুরে তিনি একটি নাটকের ওয়ার্কশপ করেছিলেন সেখানে তিনি মনিপুরি ভাষায় একটি নাটক উপস্থাপন করেছিলেন। সেখানে স্টেজের ব্যবস্থা ছিল উন্মুক্ত এবং ওপরে কিছু বাঁশ দিয়ে ছাদ নির্মাণ এবং মাটিতে চট দিয়ে দর্শকের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাই নাটকে লক্ষ্য করা যেত একই সংলাপ দুটো আলাদা চরিত্র কে দিয়ে বলাতেন তিনি। আবার অনেক সময়ে দেখা যেত একজন অভিনেতা দুটি চরিত্রে অভিনয় করত। যেমন তাঁর একটি নাটকে দেখা যায় একই অভিনেতা বস ও পিওন দুটি চরিত্রে অভিনয় করছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল 'শতাব্দী' যে সমস্ত নাটক মঞ্চস্থ করেছিল, তৎকালীন সময়ের পাশাপাশি আজও তা সমান গুরুত্ব রাখে।
দর্শককে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করানো ছিল বাদল সরকারের নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ১৯৬৮ সালে তাকে সঙ্গীত নাটক একাডেমি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ১৯৭২ সালে তিনি পদ্মশ্রী পান এবং ১৯৯৭ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমী ফেলোশীপ থেকে ভারত সরকারের সর্ব্বোচ্চ সম্মানিত পুরস্কার রত্ন সদস্য পদকে ভূষিত করা হয়। এই রত্ন কে আমরা ২০১১ সালের ১৩ই মে আমরা হারিয়ে ফেলি। তিনি চেয়েছিলেন দর্শক এবং মঞ্চের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টির চাইতে নাটককে দর্শকের সামনে জীবন্ত করে কাছে নিয়ে আসতে।