লোকমাতা রানি রাসমণির একাধিক কীর্তি ছড়িয়ে রয়েছে কলকাতা জুড়ে, বাবুঘাট হোক বা দক্ষিণেশ্বর; রানী মা নারী ক্ষমতায়ণে অনন্য নজির। লাল মুখো সাহেবরাও তাঁর ভয় তটস্থ থাকত। তিনিই গঙ্গা তীরে গড়ে তোলেন শ্রী শ্রী জগদীশ্বরী কালীমাতা ঠাকুরাণীর মন্দির, অর্থাৎ ভবতারিণী মন্দির যা দক্ষিণেশ্বরে নামেই পরিচিত।
জানবাজারের জমিদার গিন্নি রানি রাসমণিদেবী দেবী অন্নপূর্ণার পুজো দেওয়ায় জন্যে কাশীতে যাওয়ার মনস্থ করেন। যেই ভাবা সেই কাজ তীর্থযাত্রার আয়োজন হল। ২৪ টি নৌকায় আত্মীয় পরিজন, দাস-দাসী ও রসদ নিয়ে যাত্রা করবেন ঠিক করলেন। কিংবদন্তি অনুসারে, যাত্রার ঠিক আগের দিন রাতে রানিমার স্বপ্নে আসেন মা কালী। তিনি তাঁকে জানান, কাশী যাওয়ার প্রয়োজন নেই রাসমণির। তিনি যেন একটি মন্দির স্থাপন করে গঙ্গাতীরেই পূজা শুরু করেন মা কালীর।
এই স্বপ্নই রাসমণিকে প্রেরণা জোগায়। তিনি গঙ্গাতীরে জমি কেনেন। জন হেস্টি নামক জনৈক এক ইংরেজ সাহেবের কাছ থেকে জন্য ২০ একর জমি কেনা হয়। সে সময় জায়গাটি সাহেবান বাগিচা নামে খ্যাত ছিল। এর একটি অংশ ছিল কচ্ছপাকার মুসলমান সমাধিক্ষেত্র। তাই তন্ত্রমতে স্থানটি শক্তি উপাসনার জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। মন্দির তৈরির বরাত যায় মার্টিন অ্যান্ড বার্ন কোম্পানির কাছে, দাঁইহাটের পটুয়ার হাতে মা গড়ে ওঠেন। আটবছরে নয় লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই মন্দির নির্মিত হয়। জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রার দিন ১৮৫৫ সালের ৩১ মে মন্দিরের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা করেন রানি রাসমণি। মন্দিরটি নবরত্ন স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। দক্ষিণমুখী মন্দিরের গর্ভগৃহে শিবের বক্ষোপরে ভবতারিণী অধিষ্ঠিত। মূর্তিদ্বয় একটি রুপোর সহস্র পদ্মের দলের উপর স্থাপিত। নাট মন্দির, রাধাগোবিন্দ মন্দির ও ১২ টি শিব মন্দির নিয়ে দেড় শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দক্ষিণেশ্বর।
কলকাতার রক্ষণশীল সমাজ 'শূদ্র'-প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে পুজো করা নিয়ে আপত্তি তোলে। হুগলির কামারপুকুরের রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কে পৌরোহিত্যের কাজে নিয়োগ করেন রাসমণি। এক বছরের মধ্যেই রামকুমার তাঁর ভাই গদাধরকে নিয়ে আসেন পুজোর কাজে সহায়তার জন্য। গদাধরই যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী ভাবে যাঁর নাম জড়িয়ে রয়েছে তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংস। ১৮৫৫ সালে দাদা রামকুমারের সহযোগীরূপে এখানে আসেন। পরে রামকুমারের মৃত্যুর পর তিনি দাদার স্থলাভিষিক্ত হন। ১৮৮৬ পর্যন্ত প্রায় তিন দশক শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে ছিলেন। তাঁর সহধর্মিনী সারদা দেবী মন্দির চত্বরের বাইরে নহবতখানায় থাকেন। এই নহবতখানা এখন সারদা দেবীর মন্দির।
শ্রীরামকৃষ্ণের এই মন্দিরে অবস্থানের কারণে পরবর্তীকালে এই মন্দির পরিণত হয় একটি তীর্থক্ষেত্রে। আজ এটি ভক্তদের পবিত্রপীঠ।
আজ দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের ১৬৭তম প্রতিষ্ঠা দিবস। ১৮৫৫ সালের আজকের দিনেই লোকমাতা রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।