স্বনামধন্য গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার একটি গানের কথায় লিখেছিলেন 'যদি কাগজে লেখো নাম কাগজ ছিঁড়ে যাবে/ পাথরে লেখো নাম পাথর ক্ষয়ে যাবে/ হৃদয়ে লেখো নাম সে নাম রয়ে যাবে'- গানটা নিশ্চই আপনাদের মনে আছে, থাকারই কথা। কারণ মান্না দের দরদ ভরা গলা গানটিকে অমর করে রেখেছে আর ডক্টর নচিকেতা ঘোষও অনবদ্য সুরারোপ করেছিলেন কিন্তু সত্যিই কি পাথরে নাম লিখলে সে পাথর একদিন ক্ষয়ে যায় সময়ের ঘষা লেগে? হয়তো তাই। সেরকমই একটা পাথরের গল্প বলি যে পাথর সাবেক কলকাতার এক অনন্য সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষে ১৮৪৯/৫০ সালে, ঢাকার জমিদার হন আবদুল গনি, আবদুল মাত্র সাতাশ বছর বয়সে ইংরেজদের সাথে এমনই সখ্যতা গড়ে তোলেন যে ইংরেজ সরকার তাকে নবাব উপাধি দেয়। শুধু তাই নয় তার সাথে দেয় সেই উপাধি বংশপরম্পরায় ব্যবহারের অধিকার। ১৮৫৭তে গোটা দেশে যখন সিপাহী বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে, তখন ইংরেজদের নৌবহর বা হাতি-ঘোড়া দিয়ে যথেষ্ট সাহায্য করেন তাদের বিশ্বস্ত আবদুল গনি। তৎকালীন বেংগল প্রেসিডেন্সির শাসক হ্যালিডে সাহেব তার প্রতিবেদনে আবদুল গনির ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৮৬০ সালে ঢাকায় যখন শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে দাঙ্গা দেখা দেয় ইংরেজ সরকার তা থামাতে ব্যর্থ হয়েছিল। তখন নবাব আবদুল গণি তিন দিনের চেষ্টায় ঢাকাকে দাঙ্গা মুক্ত করেছিলেন। ইংরেজ সরকার দারুণ খুশি হয়ে আবদুল গনিকে সি.এস.আই (কম্পানিয়ন অব দি অর্ডার অফ দি স্টার অব ইন্ডিয়া) উপাধি দিয়ে সন্মানিত করে। ১৮৭৫ সালের শেষদিকে ডিসেম্বর মাসে প্রিন্স অফ ওয়েলস-এলবার্ট এডওয়ার্ড আসেন কলকাতায়। ইংরেজ প্রভুর কলকাতায় আগমন কে স্মরণীয় করে রাখতে তিনি কলকাতায় দুটি শীলালেখও খোদাই করেন। ফিরে আসি ২০১৯-এ, এই যে নবাব আবদুল গণি প্রিন্স অফ ওয়েলস এর সন্মানে কলকাতার বুকে দুটি শীলালেখ খোদাই করে গেলেন এগুলি তো কলকাতার ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ, তা আজও কি এগুলোর দেখা মেলে কলকাতায়? একটি লেখ রয়েছে ফেয়ারলি প্লেসে আর একটি কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলা বা এসপ্লানেড সংলগ্ন লেনিন সরনীর একদম শুরুতেই, টিপু সুলতান মসজিদের সামনে। তবে টিপু সুলতান মসজিদের সামনে এসে সৌধটিকে খুঁজে নাও পেতে পারেন, কারন পার্শ্ববর্তী ফুটপাতের হকার'রা সৌধটিতেই দড়ি বেঁধে জামাকাপড় ঝুলিয়ে রাখেন আর ঠিক লেখ-র ওপরেই সারা বছর ঝুলতে থাকে কোন না কোন রাজনৈতিক দলের পোস্টার। স্মৃতিসৌধটিতে বেলে পাথরের ওপর যে বক্তব্য খোদাই করা তা হলো "Erected by Nawab Abdul Gunny C. S. I. and his son Nawab Ahsonollah Khan Bahadoor of Dacca to commemorate the visit of H. R. H. ALBERT EDWARD PRINCE OF WALES to Calcutta in 1875", লেখটিতে যে H.R.H. লেখা রয়েছে তা আসলে "His Royal Highness", ফেয়ারলি প্লেসের কাছে বর্তমান ইস্টার্ন রেলের সদর দপ্তরের কাছেই নবাব আবদুল গণি যে আর একটি সৌধ স্থাপন করেছিলেন তার লেখটিতে "His Royal Highness" এই পুরো কথাটাই খোদিত তবে এই লেখটির স্বাস্থ্য বর্তমানে একটুও ভালো নেই। বোধহয় প্রত্নতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিকেরা এটির ক্ষয় ক্ষতি নিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন নন, কলকাতা পুরসভা, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বা হেরিটেজ কমিশনও তথৈবচ! কিন্তু যারা বিশ্বাস করেন এই কলকাতার মধ্যে আছে আর এক কলকাতা, আমার প্রশ্ন তাদের কাছে ইতিহাস কি আমাদের ক্ষমা করবে? আশা করি কলকাতা প্রেমীরা বা কলকাতার ইতিহাসকারেরা তাদের নিজেদের স্বার্থেই তাদের এই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট হবেন ।