কুমীরের উপদ্রব থেকে বাঁচান উত্তরবঙ্গের এই লৌকিক দেবতা

উত্তরবঙ্গের রায়ডাক নদীকে কেন্দ্র করে প্রচলিত আছে একটি লৌকিক বিশ্বাস। যে সময় নদী সংলগ্ন অঞ্চলগুলোর যাতায়াতের ব্যবস্থা বলতে ছিল কেবলমাত্র নৌকো, এটা সেই সময়ের কথা। নৌকা ডুবি, জলে ডুবে মৃত্যু এবং কুমীরের আক্রমণে প্রায়শই মানুষ মারা যেত ওইসব অঞ্চলে। রায়ডাকের পাড়ে যেসব জেলে সম্প্রদায়ের লোকেরা বসবাস করত তাদেরও প্রত্যেকদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই জলে মাছ ধরতে যেতে হত। অনেকেই কুমীরের উপদ্রবে মারা যেতেন। সকলে কুমীরের আক্রমণের ভয়ে তটস্থ থাকতেন। সেই থেকে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মায় কুমীরের আরাধ্য কোনও দেবতাকে পুজো দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতে পারলে কুমীরের আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। সেই থেকে রায়ডাকের তীরে কুমিরের আরাধ্য দেবতা হিসেবে কালকুমীর ঠাকুরের পুজোর প্রচলন হয়। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার বক্সিরহাট থানার রসিক বিলের পাগলী কুঠি আর ব্রজের কুঠিতে কালকুমীর ঠাকুরের থান দেখতে পাওয়া যায়। রায়ডাক অঞ্চলের নদীর তীরেও বেশ কয়েকটি বাড়িতে কালকুমীর ঠাকুরের থান রয়েছে। এই ঠাকুরের পুজো একবার কোন বাড়িতে শুরু হলে তা বন্ধ করা যায় না। সেই পরিবারের কোনও উত্তরসূরিকে এই পুজো চালিয়ে যেতে হয়। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার বক্সিরহাটের রসিক বিলের পাগলী কুঠিতে রাভা জনজাতির লোকেদের মধ্যে এই পুজোর চল রয়েছে।

কালকুমীর ঠাকুর কারও উপর অসন্তুষ্ট হলে সেই ব্যক্তিকে আক্রমণ করেন । কালকুমীর ঠাকুরের প্রকোপ পড়লে সেই রোগী নাকি কুমীরের মতো আচরণ করে। ‌ প্রচন্ড রাগ জন্মায় তার মধ্যে। ‌ এমনকি তাঁর দৃষ্টিশক্তিও চলে যায়।

কালকুমীর ঠাকুরের থানে এসে আক্রান্ত ব্যক্তির হয়ে পরিবারের কাউকে দই, চিঁড়ে, বীজকলা, দুধ মানত করতে হয়। তারপর ওই থানের দেউসী আক্রান্ত ব্যক্তিকে সামনে রেখে কালকুমীর ঠাকুরকে মানতের দুধ, বীজকলা, চিঁড়ে উৎসর্গ করেন। এতে সন্তুষ্ট হয়ে কালকুমীর আক্রান্ত ব্যক্তিকে রেহাই দেন, এমনটাই প্রচলিত আছে।

পাগলীকুঠির থানে কালকুমীর ঠাকুরের বাৎসরিক পুজো অন্যান্য লৌকিক দেবতার সঙ্গে প্রত্যেক বছর মাঘ মাসের ১৫ তারিখ উদযাপন করা হয়। তার আগে সাত দিন ধরে নিত্য পুজো চলে। এই সময় বাঁশ জাগানোর মন্ত্র পড়ে বাঁশ জাগানো হয়। এই সময় মাগন সংগ্রহ করা হয়।

কালকুমীর ঠাকুরের পুজোয় নদীর জল লাগে। নদীর জল ছাড়াও দই, চিঁড়ে, দুধ বীজকলা এবং গুড় লাগে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী যাদের বাড়িতে কালকুমীর ঠাকুরের পুজো হয় তাদের নাকি পুজোর সময় ভর ওঠে। এখানে মূর্তি পুজোর চলে রয়েছে। তবে একেকটি থানে মূর্তির ধরন একেক রকম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনেকটা কার্তিক ঠাকুরের মত। কাল কুমীর ঠাকুরের বাহন কুমীর। কুমীরের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এই ঠাকুরকে পুজো করা হয়, এভাবেই এই লৌকিক দেবতা আপনজন হয়ে ওঠেন ওই অঞ্চলের মানুষের।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...