মাকাল ঠাকুর বা কোথাও কোথাও উচ্চারণ ভেদে মাখাল ঠাকুর হলেন মৎস্যজীবী-জেলে সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা। দক্ষিণবঙ্গের নিম্নগাঙ্গেয় ও জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চলে কৃষক ও জেলে সম্প্রদায় মানুষেরা মাকাল ঠাকুরের পুজো করে। মাকাল শব্দটি মহাকালের অপভ্রংশ। অনেকে ঐতিহাসিকের মতে, মহাকাল শব্দটির ধ্বনি লোপ পেয়ে মাকাল শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।
চব্বিশ পরগনার পল্লীসমাজে মহাদেবের বিভিন্ন পূজাচারের সঙ্গে মাকাল ঠাকুরের পুজোর সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। মাকাল ঠাকুর এবং গ্রামাঞ্চলে শিবের লৌকিক পুজো মিলে মিশে একাকার ওঠে গিয়েছে। এই সাদৃশ্যই মাকাল ঠাকুরকে শিব মনে করার অন্যতম কারণ। মাকাল ঠাকুরের পুজোর প্রধান উপকরণ হল বাতাসা। পুকুরে মাছ চাষ করার আগে মাকাল ঠাকুরের পুজো দেওয়ার রীতির প্রচলন অতিপ্রাচীন। পুজো বলতে তেমন বিরাট কিছু আয়োজন নয়।
রেকাবি বা শালপাতা অথবা কাগজের ঠোঙায় সামান্য বাতাসা। কোথাও কোথাও তার সঙ্গে কিছু ফলমূল এবং চিনির সন্দেশ। এমনকি পুজো করতে লাগে না কোনো ব্রাহ্মণ পুরোহিতও। মাছচাষিরা নিজেরাই খড় জ্বালিয়ে পুজো করে মাকাল ঠাকুরকে। বড় রেকাবিতে বাতাসা, ফুল, জল, বেলপাতা। তাতেই ঠাকুর খুশি। উপকরণেও শিবের পুজোর সঙ্গে মাকাল ঠাকুরের পুজোর সদৃশ্য রয়েছে।
কলাপাতায় মাকাল ঠাকুরের বেদীর সামনে অর্ঘ্য দেওয়া হয়। ধুপ, প্রদীপ জ্বেলে আরাধনা হয়। কিন্তু সন্ধ্যেবেলা দেবতার কাছে একটি খড় জ্বালা হয়। যে বা যারা মাছ ধরতে যায় তারা এই পুজো নিজেরাই করেন। শিবের পুজোতেও অনুরূপ পুজো পদ্ধতি আছে। শিবের পুজোতে বিশেষ করে গাজনের সময় বাতাসের ডালা দেওয়া হয় ও খড়ের আগুন জ্বালানো হয়। লোকজীবনের সঙ্গে মিলে মিশে যায় দেবতাদের কাহিনি।
প্রচলিত পালাগানে শিবের চাষ পালায় মৎস্য শিকারী রূপে মহাদেব ও গৌরী দেবীকে দেখা যায়। একদিকে তারা ধানক্ষেতের জমা জলে মাছ ধরছেন, তেমনিই অপরদিকে সেই মাছ মাথায় করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছেন। অনুমান করা যায় এই কারণে মৎসজীবি সম্প্রদায় হরগৌরীকে জেলেদের দেব-দেবী রূপে কল্পনা করে পুজো করে। প্রচলিত লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, পুকুরের মধ্যে মাকাল ঠাকুরের যে'দুটি রূপ বর্ণনা করা হয় সেগুলো হল মহাকাল শিব ও অপরটি স্ত্রী গৌরী। লোকসংস্কৃতি অনুযায়ী, মাকাল ঠাকুর ও লৌকিক হরগৌরীর পুজো এক এবং অভিন্ন। সম্প্রদায়ভেদে শিব ঠাকুরের আরাধনার যে বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়, তারই মধ্যে মাকাল ঠাকুরের পুজো অন্যতম একটি।
মধ্যযুগের শেষ পর্যায়ে রচিত বেশ কয়েকটি কাব্যে মাকাল ঠাকুরের উল্লেখ পাওয়া যায়। তারকেশ্বর শিবতত্ত্ব এবং প্রায় একই সময়ে লেখা বলরাম কবিশেখর রচিত কালিকামঙ্গল গ্রন্থের "দিগ্বন্দনা" অংশে মাকাল ঠাকুরের উল্লেখ রয়েছে।
গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর মতে, কর্ণাটক রাজ্যের মহীশূর অঞ্চলের গ্রাম্যদেবী কানিয়াম্মার সঙ্গে মাকাল ঠাকুরের সাদৃশ্য দেখা যায়। কানিয়াম্মাও মৎস্যজীবীদের উপাস্য, পার্থক্য শুধু মাকাল ঠাকুর পুরুষ দেবতা ও কানিয়াম্মা দেবী।
আবার মাকাল ঠাকুরের সহচর হিসেবে কোথাও কোথাও আট-মাকাল নামে আরেক দেবতাকে পূজা করা হয়। সুন্দরবনসংলগ্ন অঞ্চলে আট-মাকাল পুজোর প্রচলন রয়েছে। প্রচলিত লোক কাহিনী অনুযায়ী, আট বা আটেশ্বর হলেন অরণ্যরক্ষক দেবতা। তাই বনাঞ্চলে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে মৎস্যজীবীরা আট মাকালের আরাধনা করেন।
আট-মাকাল হল সাতটি ছোট ছোট মাটির স্তূপ যা বেদির উপর রাখা হয় এবং আট বা আটেশ্বরের স্তূপটি বড় করে তৈরি করা হয়। সুন্দরবন অঞ্চলের মৎস্যজীবীরা বিশালাক্ষী ও খালকুমারীসহ কয়েকজন দেবীরও আরাধনা করেন। ঐতিহাসিকেদের মতে, খালকুমারী থেকে ‘মাখাল’ বা ‘মাকাল’ শব্দের বুৎপত্তি হতে পারে, যদিও মৎস্যজীবীদের বিশ্বাস মাকাল পুরুষ দেবতা।
হাওড়া জেলায় গ্রামাঞ্চলের মৎস্যজীবীরা মাকাল ঠাকুরকে মাকালচণ্ডী নামে অভিহিত করেন। কিন্তু এই পূজাতেও কোনও মন্ত্র ব্যবহার করা হয় না; এমনকি লৌকিক চণ্ডীপুজার কোনও বিধিও পালন করা হয় না।
মাকাল ঠাকুরের কোনও মানুষের আকৃতিবিশিষ্ট মূর্তি নেই। মাটির একটি অথবা একসঙ্গে দুটি ছোট স্তূপের প্রতীকে পুজো করা হয়। যেখানে জোড়া প্রতীকে পুজো করা হয় সেখানে দু’টি প্রতীকের মধ্যে স্ত্রী দেবতা-পুরুষ দেবতা ভেদভেদা করা হয় না। উপাসকেরা দুটি প্রতীককেই দেবতার মূর্তি মনে করে।
এই প্রতীকটি অনেকটা উল্টানো গ্লাস বা টোপরের মতো দেখতে। জেলে সম্প্রদায় মূর্তি বিহীন মাটির বেদীকে মাকাল ঠাকুরের থান হিসেবে কল্পনা করেন। কোন কোন ক্ষেত্রে মাঠের উপর কাদা মাটির একটি বা দুটি আবক্ষ মূর্তি তৈরি করা হয়। মূর্তি অতি সাধারণ, নির্মাণ পদ্ধতি অতি সহজ। পুকুরের খোল থেকে আঠালো পাঁকমাটি অল্প নিয়ে দুই হাতের তালুতে রগড়ে চার ছয় ইঞ্চি লম্বা ও দু তিন ইঞ্চি ব্যাস যুক্ত করা হয়। তারপর তর্জনী বুড়ো আঙ্গুলের চাপ দিয়ে নাক, চোখ, মুখ তৈরি করে পূজার বেদীতে বসানো হয়। এই মূর্তিকে শিব লিঙ্গের মত দেখতে হয়। এইরূপ মূর্তি তৈরি হত কুষাণ যুগে। এটিই মাকাল ঠাকুর। মৎস্যজীবী সম্প্রদায় মূর্তিহীন মাটির থানকে মাকাল ঠাকুর বলে পুজো করে।
আবার অনেক জায়গায় সরল গঠনের কিছু আবক্ষ মূর্তিও থাকে। মাকাল ঠাকুরের স্থায়ী আবক্ষ মূর্তি বা কেবল মুন্ড পুজিত হতে দেখা যায়। মাকাল ঠাকুরের মূর্তি কাঁধ পর্যন্ত চুল, বিশাল ঝুলন্ত বিস্ফারিত চোখ, কান কুন্ডল ও গলায় গলাপটি। এরূপ মূর্তি উত্তর চব্বিশ পরগনার ভেরি অঞ্চলে দেখা যায়।
মাকাল ঠাকুরের পুজোর নির্দিষ্ট কোনও স্থান বা কাল নেই। মৎস্যজীবীরা কোনও জলাশয়ে মাছ ধরতে গেলে সেই জলাশয়ের তীরে এঁর পূজা করেন। সেখানে জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সমতল করে নেওয়া হয়। তার ঠিক মাঝখানে মাটি দিয়ে তিনটি থাকযুক্ত একটি ছোট বেদি তৈরি করা হয়। বেদির ঠিক মাঝখানে প্রতীক স্তুপ, একটি বা দুটি স্তুপ বসানো হয়। বেদির চার কোণে চারটি তিরকাঠি পুতে সেগুলি পরস্পর লাল সুতো দিয়ে সংযুক্ত করে বেদির একটি আবরণ বা বেড়া তৈরি করা হয়। প্রতীকের উপর লাল রঙের চাঁদোয়াও টাঙানো হয়।
পূজায় ব্রাহ্মণ পুরোহিতের প্রয়োজন হয় না; এমনকি পূজার কোনও মন্ত্রও নেই। মৎস্যজীবীদের দলের সর্দারই নিজ ভক্তি ও কল্পনা অনুযায়ী পুজো করেন। অবশ্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেয়াসি শ্রেণির ব্রাহ্মণ পুরোহিত মাকাল ঠাকুরের পুজো করে থাকেন। পুজোর সময় তিনবার "গুরু সত্য" কথাটি উচ্চারণ করেন। প্রতীকের উপরের অংশে সিঁদুর লেপে তার উপর ফুল ও বেলপাতা রাখা হয়। সামনে একটি ঘট পাতা হয়। একটি প্রদীপ জ্বালা হয়।
মাটির থালায় কিছুটা আতপ চাল, একছড়া পাকা কলা ও কয়েকটি বাতাসা মাত্র দিয়ে নৈবেদ্য দেওয়া হয়। অপর একটি থালায় শিশুদের চুষিকাঠি, লাট্টু, ঘুনসি, ধান, দূর্বা ও তুলসীপাতা দেওয়া হয়। এছাড়া একটি নতুন কলকে ও কিছুটা গাঁজা দেওয়া হয়। পুজোর শেষে ফুল চাপানো নামে একটি কৃত্য পালন করা হয়। প্রতীকের উপরের অংশে একটি ফুল রাখা হয়। উপাসকদের বিশ্বাস, ফুলটি যদি আপনা থেকে মাটিতে পড়ে যায়, তাহলে অনেক মাছ জালে উঠবে। এই পূজায় কোনও বাজনা বা বলিদানের প্রথা নেই। সুন্দরবনের জেলেরা মাছ ধরতে যাওয়ার আগে নদী বা খাল পাড়ে মাকাল ঠাকুরের পুজো করে। ভক্তদের বিশ্বাস, ঠাকুর সন্তুষ্ট হলে প্রচুর মাছ পাওয়া যাবে। যতদিন না মাছ ধরার কাজ সম্পূর্ণ হয় ততদিন এর পুজো চলে।
মাকাল ঠাকুরের নির্দিষ্ট থান না থাকলেও, কোনও কোনও গ্রামে অন্য কোনও লৌকিক দেবতার সহচররূপে তাঁদের থানে বা মন্দিরে মাকাল ঠাকুরের পুজো করা হয়ে থাকে। বেলেঘাটা খালের পূর্ব পাড়ে নওয়াবাদ-গোলাবাড়ির একটি থানে দক্ষিণরায়, পঞ্চানন্দ প্রমুখের সঙ্গে মাকাল ঠাকুরের প্রতীক স্থানীয় কৃষক ও মৎস্যজীবীরা পুজো করেন। সুন্দরবনের কাছে কয়েকটি গ্রামেও অনুরূপ থান দেখতে পাওয়া যায়। এই অঞ্চলের মৎস্যজীবীদের মধ্যে মাকাল পদবি দেখা যায়, এছাড়া উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় মাকাল নামযুক্ত একাধিক গ্রামও রয়েছে, যেমন মাকালপুর, মাকালতলা ইত্যাদি।
আমাদের লৌকিক ইতিহাসের সঙ্গে মিশে রয়েছেন মাকাল ঠাকুর। মাকাল ঠাকুরের যুগ্ম মূর্তিটির বিশেষ তাৎপর্য আছে। কাদামাটি দিয়ে তৈরি মাকাল ঠাকুরের যুগ্ম কাল্পনিক মূর্তি দেবদেবী সম্পর্কিত নিরাকার অবশেষ রূপে ধরা হয়। যা খ্রিস্টপূর্ব যুগের বলে অনুমান করা যায়।
কাদার যুগ্ম প্রতীককে যেমন নারী ও পুরুষ রূপে ভাবা যায়, তেমনি এদের একে অন্যের অনুচর রূপেও কল্পনা করা যায়। শিব, হরগৌরি, ভোলেবাবার দেব রূপের আদিমতম ধারার সঙ্গে মাকাল ঠাকুর মিলে মিশে এক হয়ে গিয়েছে। প্রকৃতিকে পুজো করার মানুষের আদিম রীতিটিও ধরা রয়েছে মাকাল ঠাকুরের উপাসনার মধ্যে, সভ্যতার ইতিহাস এবং লৌকিক ইতিহাস কোথাও গিয়ে যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। অনন্য উপাখ্যান হয়ে দাঁড়িয়েছে মাকাল ঠাকুরের আরাধনা।