বীরাঙ্গনা বাসন্তী দেবী

ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় খেতে এসেছে চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়িতে। কাঁসার থালায় সাজিয়ে গুছিয়ে খাবার পরিবেশন করা হয়েছে তাঁকে। কুমড়ো খেতে মোটেই পছন্দ করতেন না ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। এদিকে খাবার পরিবেশনকারিনী নাছোড়বান্দা। অবশেষে কুমড়োর ছেঁচকি খেতেই হল ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়কে। তবে খেয়ে মন ভরল এই স্বদেশী আন্দোলনের সাধকের। একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে বলেই ফেললেন মনের কথা।

“আরেকটু কুমড়োর ছেঁচকি দিন তো বৌঠান।”

নব বিবাহিতা নাকে নোলক পরা অষ্টাদশী বৌটি তখন হাতায় করে পাতে ঢেলে দিলেন কুমড়োর ছেঁচকি। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে সেই নারী তখন দেখছেন মুণ্ডিত মাথা আর গেরুয়া পোশাক পরা সাধক, স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি নিষ্ঠাবান এই মানুষটিকে। তাঁর ভিতরে একটা শীতল স্রোত বইছে তখন। সাধককে দেখে বারবার মনে হচ্ছিল এমন সাধনায় যদি নিজের জীবন নিয়োজিত করা যায়। কিন্তু অষ্টাদশী নব বিবাহিতা যুবতী তখন ভরসা পাচ্ছিলেন না মনের কথা বলার। আসলে এই নারী তাঁর স্বামীর সঙ্গে বিবাহ নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন না একেবারে। বাসন্তী দেবী আর চিত্তরঞ্জন দাশের বিয়ের গল্পের শুরুটা এমনই।

ভুবনমোহন দাশের পুত্র চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে যখন বাসন্তী দেবীর বিয়ে ঠিক হয়, তখন মোটেই আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না ভুবনমোহন দাশের পরিবারের। বাসন্তী দেবীর বাবা বরদানাথ হালদার যখন চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন, তাঁর পরিবার তখন ঋণগ্রস্ত। অনেক বাঙালি শিক্ষিত পরিবার এই সিদ্ধান্তে রীতিমতো অসন্তুষ্ট ছিলেন।

 

BasantiDevi1

বাসন্তী দেবী নিজেও চোখের জল সামলাতে পারছিলেন না বিয়ের আগে। বাবার কাছে একদিন বলেছিলেন অভিমানের কথা। বরদানাথ হালদার তখন তাঁর মেয়েকে বুঝিয়েছিলেন, “বাসন্তী, তোকে যার হাতে দিচ্ছি, একদিন দেখবি ভারতের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত তার নাম ধ্বনিত হবে।”

 বাবার কথা বিশ্বাস করেই সেদিন চিত্তরঞ্জন দাশকে বিয়ে করেছিলেন বাসন্তী দেবী। স্বামীর কর্মকান্ড সরাসরি দেখে বদলে যায় বাসন্তী দেবীর মন। নিজেও স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করতে শুরু করেন।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন চিত্তরঞ্জন দাশ। এদিকে উকিল হিসেবে তখনও প্রসার জমেনি। তাই দেশের জন্য লড়াই করার পাশাপাশি যুদ্ধ করেছেন দারিদ্র্যের সঙ্গেও। আর স্বামীর সঙ্গ দিয়েছেন বাসন্তী দেবী।

১৮৮০ সালের তেইশে মার্চ জন্ম বাসন্তী দেবীর। বাবা বরদানন্দ হালদার আসামের জমিদারির দেওয়ান ছিলেন। কলকাতার লোরেটো কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন বাসন্তী দেবী। পড়াশোনা করতে করতেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তাঁর।

দেশের প্রতি চিত্তরঞ্জন দাশের ভালোবাসা, নিষ্ঠা উদ্বুদ্ধ করেছিল বাসন্তী দেবীকেও। খিলাফত আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন তিনি। অসহযোগ আন্দোলনের ভূমিকা ছিল অনন্য। তবে তিনি বারবার চিত্তরঞ্জন দাশকে প্রশ্ন করতেন স্বাধীনতা আন্দোলনে মহিলাদের ভূমিকা নিয়ে। মহিলাদের ভূমিকা আরো সক্রিয় হওয়া উচিত বলে মনে করতেন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়কে দেখেও আন্দোলনে যোগদান করার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন বাসন্তী দেবী। স্বামীর কাছে প্রথমবার ব্যক্ত করেন তাঁর ইচ্ছার কথা। যথারীতি খুশি মনে সায় দিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ।

 

BasantiDevi2

স্বাধীনতা আন্দোলনের দীর্ঘ পথ তাঁরা দুজনে হেঁটেছেন একসঙ্গে। তবে বাসন্তী দেবী মহিলা আন্দোলনকারীদের নিয়ে বেশি কাজ করেছেন। ১৯২০ সালে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের নাগপুর কর্ম সভায় যোগদান করেছিলেন। পরের বছরই উর্মিলা দেবী এবং সুনিতা দেবীর সঙ্গে মিলে তিনি একটি মহিলাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলেন। ‘নারী কর্ম মন্দির’। সংসার, সন্তান ও পারিবারিক সেবার মত কাজের বাইরেও মেয়েদের জীবন ঠিক কতখানি বিস্তৃত তা বোঝাতেন বাসন্তী দেবী। তাঁর এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে অনেক মেয়েকে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করার জন্য। অসহযোগ আন্দোলনের সময় জাতীয় কংগ্রেসের বিদেশি দ্রব্য বর্জন কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বাসন্তী দেবীর।

তাঁর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পাঁচ জন মহিলাকে নিয়ে খাদির কাপড় কলকাতার রাস্তায় বসে বিক্রি করেছিলেন বাসন্তী দেবী। যথারীতি গ্রেপ্তার হন ব্রিটিশদের হাতে। মহিলাদের এমন সক্রিয় যোগদান স্বাধীনতা আন্দোলনের উজ্জ্বল অধ্যায় ছিল। ব্রিটিশ কারাগারে রুদ্ধ প্রথম বাঙালি নারী ছিলেন বাসন্তী দেবী।

পড়াশোনার ব্যাপারে আগ্রহ ছিল বাসন্তী দেবীর। চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে মিলে তিনি ‘বাংলার কথা’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি বিতর্কিত কবিতা তিনি প্রথম ছাপিয়েছিলেন তাঁর এই পত্রিকায়।

নানা শোক তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করেছে বারবার। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি বেছে নিয়েছিলেন স্বামীর কর্মজীবনকে, অবলম্বন হিসেবে। মহিলাদের নিয়ে দেশের কাজ করতেন নিয়মিত। মেয়েদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বাসন্তী দেবী অনুভব করেছিলেন মাতৃত্ব এবং কিছু শারীরিক সমস্যার জন্য মেয়েরা আন্দোলনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। তবে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পেলে এই বাধা অতিক্রম করা যায় সহজেই। এই ভাবনা থেকে গড়ে তুলেছিলেন ‘চিত্তরঞ্জন সেবা সদন’। মায়েদের জন্য গড়ে ওঠা প্রথম হাসপাতাল। তাঁকে সম্মান জানাতেই সরকার বাসন্তী দেবী কলেজ স্থাপন করেছিল। পদ্মবিভূষণ পেয়েছিলেন বাসন্তী দেবী। বাবা-মা এবং স্বামীর মৃত্যু সহ্য করে নিলেও মেনে নিতে পারেননি সন্তানের মৃত্যু। তাঁর সন্তান চিররঞ্জনর-এর মৃত্যুর পর রাজনৈতিক জীবন থেকে সরে এসেছিলেন বাসন্তী দেবী। তবে তাঁর কাজ, বোধ, চেতনা দেশকে দেশের মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করে কাছে সবসময়।  আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করতে চলেছি আমরা। এই সময়ে সুস্থ সমাজ গঠনে এমন সব মহিলাদের কথা আমাদের উদ্বুদ্ধ করুক, এটাই কাম্য।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...