তাঁকে বলা হয় ভারতীয় গণসঙ্গীতের ‘ফার্স্ট লেডি’। একার জোরে বদলে দিয়েছিলেন বাংলা গণ সঙ্গীতের ধারা। সলিল চৌধুরীর স্বপ্নকে দিয়েছিলেন রক্ত-মাংসের শরীর। রুমা গুহঠাকুরতা। ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার’ ছিল তাঁর কাছে সন্তানের মতো।
দীর্ঘ ছ’ দশক ধরে বাঙালির মন ও মননের সঙ্গী। বাংলা গানের প্রচলিত ধারায় বদল এনেছিল ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার’। একটা সময়ে ‘গণসঙ্গীত’কে কার্যত একার চেষ্টায় সাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন রুমা গুহঠাকুরতা । আশি-নব্বইয়ের দশকে বাঙালির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানে সেখানে কয়্যারের গান থাকবেই।
১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কয়্যার’। তৈরির ভাবনাটা সলিল চৌধুরীর। বম্বে কয়্যার-এর অভিজ্ঞতা ছিলই। এবার ফের নতুন ‘কনসেপ্ট’ মাথায়।
তখন মধুমতী ছবির মিউজিক করছেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আইপিটিএ-এর জনপ্রিয় গানগুলোকে নতুন করে ফিরিয়ে আনা, মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা এল মাথায়। তৈরি হল নতুন ধাঁচের সংগঠন। সঙ্গে ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের মতো ব্যক্তিত্ব। ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের প্রথম সভাপতিও তিনিই।
দল চালানোর ব্যাটন তরুণী রুমা’র হাতে।
‘রুমা’ তখন রুমা ঘোষ। জন্ম ব্রাহ্ম পরিবারে। মা সতী ঘোষ ছিলেন নামকরা সঙ্গীত শিল্পী। মাসি বিজয়া রায়। পুরো পরিবারই গানের পরিবার। ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন (আইপিটিএ) তে গান গাইতেন ১০ বছর বয়স থেকে। পাশাপাশি নাচের চর্চায় চলত। শিক্ষক উদয়শঙ্কর। আবদুল রহমান খাঁ সাহেবের কাছে এক বছর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন রুমা।
কয়্যারে আইপিটিএ-এর গানের পাশাপাশি রবিঠাকুর, নজরুল, ডি.এল রায়, অতুলপ্রসাদ , প্রেম ধাওয়ান, শৈলেন্দ্র’র গানও গাওয়া হত। আঞ্চলিক ভাষার গানের বাংলা ভার্সন গাওয়া হত অনুষ্ঠানে।
‘ আমার প্রতিবাদের ভাষা’, ‘আজ যত যুদ্ধবাজ’, ’‘আলোর পথযাত্রী’, ভূপেন হাজারিকার ‘ ও গঙ্গা বইছ কেন’ এই দুটি গান ছিল জনপ্রিয়তম। কোনও অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হত না এই গান ছাড়া।
একশোর বেশি সদস্য যুক্ত ছিল কয়্যারের সঙ্গে। শুধু বাঙালি নয়, হিন্দিবলয়েও জনপ্রিয় ছিল কয়্যার। মানুষের ব্যথা, যন্ত্রণা, সংগ্রামের গান গাইতেন তাঁরা। দেশ-বিদেশ একাকার হয়ে যেত। পল রবসন, হ্যারি বেলাফন্টে, পিট সিগার কে নেই সেখানে! শহরের বড় মঞ্চে যেমন সেই গান শোনা যেত তেমনি গ্রাম, মফস্বলেও। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের গানের মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন।
৬০ বছর ধরে প্রায় ৫ হাজারেরও বেশি স্টেজ শো করেছে এই ‘গানের দল’।
কোপেনহেগেন ইয়ুথ ফেস্টিভ্যালে প্রথম হয়। সেই ধারা ক্ষীণ হয়ে গেলেও হারিয়ে যায়নি। ভারতীয় গানের ইতিহাসে এবং শ্রোতাদের ম্নেয়াজও ক্যালকাটা ইয়ুথকয়্যারের গানের ঐতিহ্য উজ্জ্বল।
তুখোড় অভিনেত্রী, সুগায়িকা হয়েও রুমা গুহ ক্যালকাটা ইয়ুথকয়্যারের জননী হিসেবেই আজও জেগে মানুষের স্মৃতিতে। সাদা শাড়ী, লাল টিপ আর প্রসন্ন মুখ, উদাত্ত কণ্ঠের প্রধান গায়িকা…
তথ্য ঋণ ( দ্য ওয়ার)