১৯৭৭ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত করে। তিনিই প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী। রয়্যাল সোসাইটি অব হর্টিকালচার ম্যাগনেলিয়া ফুলের নাম বদলে দেয় তাঁর নামেই। ভারতীয় মহিলা বিজ্ঞানীর মেধার প্রতি সম্মানে।
যে সময়ে পর্দার আড়ালে অবনত থাকাই ভারতীয় মহিলাদের একমাত্র ভবিষ্যৎ ছিল সেই সময়ে একা লন্ডন পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর বয়সী অন্য মেয়েরা যখন স্কুলে যাবার ছাড়পত্র না পেয়ে অশিক্ষার অন্ধকারকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে তখন চেনা গণ্ডি চেনা ছক ভেঙ্গে মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় চলে এসেছিলেন একা একা। তিনি জানকী আম্মল।
পুরো নাম জানাকি আম্মাল এডাভ্যালাথ কক্কট।
জন্মেছিলেন ১৮৯৭ সালে ভারতের কেরলে তেলিচেরিতে । বাবা দেওয়ান বাহাদুর কক্কট কৃষাণ ছিলেন মাদ্রাজ হাইকোর্ট বর্তমানে চেন্নাই হাইকোর্টের সাব-জজ। ছয় ভাই পাঁচ বোনের বড় পরিবার।
কক্কট কৃষাণ মুক্তমনা মানুষ। পরিবারে মেয়েদের শিল্পে-সাহিত্যে উৎসাহ দিতেন। বাকিরা শিল্পে আগ্রহী। কিন্তু ছোট থেকেই জানকি অন্যরকম। পছন্দগুলো ভিন্নধারার। তাঁর টান বিজ্ঞানে। উদ্ভিদের প্রতি। তেলিচেরিতে ব্যাচেলার ডিগ্রির পাঠ শেষ করে চলে এলেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। বিষয় উদ্ভিদবিদ্যা। বটানিতে অনার্স। স্নাতকের পর কলেজের শিক্ষকরাই জানকীকে প্রভাবিত করলেন ‘সাইটোজেনেটিক্স’ পড়ার জন্য।
কিন্তু তার জন্য বিদেশ যেতে হবে। চেষ্টা শুরু করলেন বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপের। এর মধ্যেই এল চাকরির ডাক। মাদ্রাজের ওম্যানস ক্রিশিয়ান কলেজে যোগ দিলেন অধ্যাপক হিসাবে।
স্কলারশিপের চেষ্টা বৃথা হয়নি। সুযোগ মিলল আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পেলেন। ভারতে ফিরে আবার ওম্যানস ক্রিশিয়ান কলেজের পুরনো ক্লাসরুমে।
প্রাচ্য দেশ থেকে তিনিই প্রথম মহিলা যিনি বারবার স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। তাঁকে আবার পাঠানো হয় বিশ্ব বিদ্যালয়ে। ১৯৩১ সালে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ডিএসসি ডিগ্রি। বটানি তে পিএইচডি অর্জনকারী তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা।
দেশে ফিরে এসে আবার অধ্যপনার জগতে ফিরে গেলেন। তবে এবার অন্য কলেজের ডাক। ত্রিবান্দ্রামের মহারাজা বিজ্ঞান কলেজে প্রফেসরের পদে। বছর দুয়েক সেখানেই কাটান। পড়া- পড়ানো-ছাত্রছাত্রী ভালই লাগছেল। কিন্তু তাঁর ভাবনায় ল্যাবরেটারি। নিত্য নতুন আবিষ্কার নেশা। ১৯৩৪- এ কলেজ ছেড়ে যোগ দিলেন কয়েম্বাটরে আখ উৎপাদন ইনস্টিটিউটে। জেনেটিসিস্ট পদে। বদলে দিলেন আখ গবেষণার দিশা।
১৯৩৫-এ বিজ্ঞানী সি ভি রমন ইন্ডিয়ান অ্যাকদেমি অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠা করেন । প্রথম বছর ফেলোশিপ পান জানকী।
বেশ কয়েক বছর দেশের মাটিতে কাজ করার পর চলে গেলেন বিদেশে। লন্ডনের রয়্যাল হর্টিকালচার সোসাইটিতে। চলল গবেষণার কাজ।
ভারতের মাটি তখন অস্থির। স্বাধীনতার জন্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে। অন্যদিকে ইউরোপেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচে তখন পুরোপুরি নেভেনি। ১৯৪৫- ১৯৪৭ এই দু’বছরে পাল্টে গেল জানকীর দেশের ইতিহাস। ভূগোল। ভারতের পাশেই জন্মে হয়েছে আরও একটা নতুন রাষ্ট্রের। পাকিস্তান।
স্বাধীনতার পর নতুন করে দেশ গড়ার ডাক দিলেন স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। জওয়ান- কিষাণ-মজুরের দেশ ভারতবর্ষ। উন্নতির ভিত্তিও হবে কৃষি। নতুন বীজ চাই। নেহেরুর আহ্বান পৌঁছল লন্ডনে গবেষণারত জানকীর কাছেও। দেশ ডাকছে। তাকে প্রয়োজন।
১৯৫১ তে ফিরে এলেন তিনি ভারতের মাটিতে। বটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া পুনর্গঠন করলেন। পরের বছর ডিরেক্টর হলেন সংস্থার।
ঘাস, সঙ্কর প্রজাতির বাঁশ নিয়ে তাঁর গবেষণা যুগান্তকারী। বাগানের উদ্ভিদের ক্রোমোজম নিয়ে গবেষণা করেন ।
রয়্যাল হর্টিকালচারল সোসাইটির বাগানে ড. জানকী আম্মাল বংশগতি বিজ্ঞানী হিসাবে কাজ করার সময় ম্যাগনলিয়ার মত কিছু গাছের সদ্য অঙ্কুরিত চারায় কোলসিসাইন প্রয়োগ করলেন। দিন কয়েকপর দেখেন চারা গাছর কচি পাতাগুলো যেন তাড়াতাড়ি বেড়ে গিয়েছে। অন্য গাছের তুলনায় কোলসাইন প্রয়োগ করা গাছগুলো অনেক দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। পাতায় ফুলে তফাৎটা চোখে পড়ার মত। নতুন এই ফুলের নাম দেওয়া হয় ম্যাগনেলিয়া কোবাস।ফুল তাজাও থাকে অনেকদিন। বীজের সংখ্যাও বেশি।
এই গাছের কিছু বীজ নিয়ে জানকী ব্যাটেলস্টোন পাহাড়ে রোপণ করলেন একদিন। নতুন ফুলে ভরে উঠল ভ্যালি।
তাঁর সম্মানে ম্যাগনেলিয়ার নাম রাখা হল আম্মাল।
ভারতের উদ্ভিতবিদ্যা গবেষণায় তাঁর অবদান স্মরণে ২০০০ সালে ভারত সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রক তাঁর নামে ট্যাক্সনমিতে জাতীয় পুরস্কার ঘোষণা করে।