ছ'টি নানা রঙের ঘোড়া ছুটছে। তাদের লাগাম রয়েছে জকির হাতে। প্রাণপন চেষ্টা চলছে কে আগে ফিনিশিং লাইন টাচ করতে পারে। গ্যালারি সরগরম। সাহেবদের চিৎকার দূর থেকে শোনা যাচ্ছে।
ইংল্যান্ড নয়, খোদ কলকাতার বুকের এই ঘটনা।
সময় উনবিংশ শতাব্দী। এক আর্মেনিয়ান সাহেব, কলকাতার রেসকোর্স যাঁর মুঠোয়। সেই সময় তাঁর দেড়শো ঘোড়া কলকাতার রেসকোর্স দাপিয়ে বেড়াত।
জোহানস গলস্তাউন। এক আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী। তাঁকে বলা হত রেসকোর্সের রাজা। কলকাতা দাপিয়ে বেড়াতেন। কলকাতায় প্রায় ৩৫০টি অট্টালিকা বানিয়েছিলেন। সেই সময় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের জন্য ২৫ হাজার টাকা দানও করেছিলেন। স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ একটি সুবিশাল-সুদৃশ্য ম্যানশন তৈরি করিয়েছিলেন। নাম দিয়েছিলেন 'গলস্তাউন পার্ক'। ১৯৩৩ সালে হায়দ্রাবাদের নিজাম মীর ওসমান আলি খান ম্যানসনটি কিনে নেন এবং নাম রাখেন 'সাবা প্যালেস'। পরে নাম বদলে রাখেন 'নিজাম প্যালেস'।
আজকের ওবেরয় গ্র্যান্ড হোটেলও একজন আর্মেনিয়ানের হাতে তৈরি। নাম আরাথুন স্টিফেন। এসেছিলেন ইরানের ইসফাহান থেকে। প্রথমে ঠেলাগাড়িতে করে রত্ন বিক্রি করতেন। তারপর ১৮ নম্বর চৌরঙ্গী রোডে রত্ন ও অ্যান্টিকের দোকান খোলেন। মিসেস অ্যানি মঙ্ক নামের এক ভদ্রমহিলার ১৪, ১৫, ১৬, ১৭ চৌরঙ্গী রোডে নিজস্ব ব্যবসা ছিল। সেই সঙ্গে একটি থিয়েটারও ছিল।
১৯১১ সালে থিয়েটারটি পুড়ে গেলে আরাথুন সেটি কিনে নেন এবং সেটিকে হোটেলে পরিবর্তন করেন। নাম হয় গ্র্যান্ড হোটেল। ১৯৩০ সালে আরাথুন মারা যান। কলকাতায় টাইফয়েড মহামারী আকার নিলে ১৯৩৭ সালে হোটেলটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৩ সালে হোটেলটির মালিক হয় ওবেরয় হোটেলস এন্ড রিসর্টস। নতুন নাম হয় ওবেরয় গ্র্যান্ড হোটেল। স্টিফেন কোর্ট, স্টিফেন হাউস এবং এম্পায়ার থিয়েটারও আরাথুন স্টিফেনেরই তৈরি।
গ্র্যান্ড হোটেলের পর কলকাতার দ্বিতীয় বৃহত্তম হোটেল কেনিলওয়ার্থও এক আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীর তৈরি। ৭ নম্বর রাসেল স্ট্রিটের এই হোটেলটি বর্তমানে কলকাতার বিলাসবহুল হোটেলগুলোর মধ্যে অন্যতম। জয়েস পার্ডি কেনার পর হোটেলটি 'পার্ডি ম্যানসন' নামে পরিচিত হয়। কেনিলওয়ার্থ ছাড়া কুইন্স ম্যানসন সহ আরও বহু বাড়ি তৈরি করেছিলেন আর্মেনিয়ানরা। পার্ক ম্যানসনের নির্মাতাও থয়েডাস নামের এক আর্মেনিয়ান।
ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময় কলকাতায় প্রায় ৩০ হাজার আর্মেনিয়ান ছিলেন। বর্তমানে সংখ্যাটা মেরে কেটে একশোও হবে না। যাঁরা রয়ে গিয়েছেন তাঁদের অনেকের ঠাঁই এখন পার্ক সার্কাসের 'স্যার ক্যাথিক পল চ্যাটার হোম ফর দ্য এল্ডারলি' নামে এক বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রম চত্বরে রয়েছে বহু সমাধি।
যেসব আর্মেনিয়ানরা কলকাতায় আছেন তাঁদের কাছে কলকাতা মা-বাবার কাছে ছোটবেলায় শোনা রূপকথার এক দেশ। ইতিহাসের উষ্ণতা হাতের মুঠোয় আগলে রেখেছেন। এই দেশ, এই শহর তাঁদের ভালোবাসার যাদুকাঠি।