নিয়নের আলোয় রাতের কলকাতা সাতরঙা হয়ে ওঠে। তার বুকের উপর বেড়ে ওঠা বড় বড় বাড়িগুলো জোনাকির আলোর মতো মিটমিট করে। মোহময়ীরূপ ধরে তিলোত্তমা। চৌরঙ্গী, পার্ক স্ট্রিট, সদর স্ট্রিটের জমকালো রোশনাই নানান কাহিনি শোনায় । রূপকথারা চুপকথা হয়ে ঘুরে বেড়ায় অলিতে গলিতে।
সুজাতা মিত্র আর সত্যসুন্দর রূপকথা হয়ে স্মৃতিতে ভেসে আসে। তাঁদের প্রেম কাহিনি শুরু হয়েছিল চৌরঙ্গীর আনাচে-কানাচে।
কী বললেন, এঁরা কারা?
শঙ্করের 'চৌরঙ্গীর' স্যাটা বোসকে নিশ্চয়ই মনে আছে!
সত্যসুন্দর ওরফে স্যাটা এয়ার হোস্টেস সুজাতা মিত্রের গল্প দানা বেঁধেছিল শাজাহান হোটেলে। ঠিক সেইভাবে আরেকটি প্রেম কাহিনির সাক্ষী কলকাতার একটি হোটেল।
সদর স্ট্রিটের এই হোটেলের ১৭ নম্বর ঘরটি আজও সেই গল্প বলে চলেছে। কার্পেটে মোড়া কাঠের সিঁড়ি, বাহারি রেলিং, লাল মেঝের দালান আর সবুজ খড়খড়ি, ফেয়ারলন হোটেল সেই গল্প বুকে আগলে রেখেছে। ২৭ বছরের জেনিফার কেন্ডাল আর ২১ বছরের শশী কপূরের দাম্পত্যের ইনিংস শুরু করার কাহিনি।
সেটা গত শতকের পাঁচের দশকের কথা।
সাবেক গ্লোব সিনেমায় তখন ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার দল নিয়ে জমিয়ে শেক্সপিয়রের নাটক করছেন জেনিফার কেন্ডালের মা-বাবা লরা ও জেফ্রি। 'দ্য টেমপেস্ট'-এর মিরান্ডাকে দেখে প্রেমে পড়লেন পৃথ্বীরাজ কপূরের মেজ ছেলে শশী কপূর। জেনিফারকে বিয়ে করে ফেয়ারলন হোটেলের ১৭ নম্বর রুমে শুরু করেন তাঁদের দাম্পত্য জীবন। যদিও বিয়েটা শশী কপূরের বাড়ি থেকে ভাল ভাবে মেনে নেয়নি। তাতে তাঁদের প্রেমে কোনও ভাঁটা পড়েনি। বিয়ের পর বোধহয় একমাস এই হোটেলে ছিলেন নব দম্পতি। লরা-জেফ্রিরাও মাসের পর মাস থাকতেন এই হোটেলে।
বিয়ে, মধুচন্দ্রিমার পরে শশী-জেনিফার কলকাতায় যখনই এসেছেন পাঁচতারা বিলাসের টান উপেক্ষা করে ফেয়ারলন হোটেলে উঠেছেন। এই হোটেলের কর্ত্রী ভায়োলেট স্মিথের আতিথেয়তার মায়াতেই আবদ্ধ হতে চেয়েছেন। জেনিফার বিদায় নেওয়ার পরেও শশী কপূর কলকাতায় এলেই তাঁর ঠিকানা হত ফেয়ারলন হোটেলের ১৭ নম্বর ঘরটি।
ফেয়ারলন হোটেলটি আর্মেনিয়ান এক ব্যবসায়ীর তৈরি। ভায়োলেট স্মিথ যার কথা পূর্বে উল্লেখ করেছি তিনি এই হোটেলের কর্ত্রী। বর্তমানে তিনি আর নেই। তাঁর স্মৃতি আনাচে-কানাচে। বিশ শতকের গোড়ায় আর্মেনিয়ায় তুর্কিদের গণহত্যার সময়ে খাইবার পাস পেরিয়ে কোনও মতে ঢাকায় পালিয়ে আসেন ভায়োলেটের মা-বাবা। সেখানে কিছুদিন পাটের কারবার করার পর খুচরো পয়সা ভরা কেরোসিনের টিন নিয়ে চলে আসেন কলকাতা। এরপরই সদর স্ট্রিটে হোটেল ব্যবসার সূত্রপাত।
ভায়োলেটের সঙ্গে ইংরেজ অ্যাডমন্ড ফ্রেডরিক স্মিথের বিয়ে হয়। বিবাহ সূত্রে ভায়োলেট ইংল্যান্ডে গেলেও সেখানে বেশি দিন থাকেননি। কলকাতার প্রতি প্রেম তাঁকে সেখানে বেশিদিন থাকতে দেয় নি। ছয়ের দশকে বরকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং হোটেলের দায়িত্বভার নেন। হয়ে ওঠেন 'ডাচেস অফ সদর
স্ট্রিট'। এই নামেই ভায়োলেট স্মিথ কলকাতার বুকে পরিচিত। কলকাতাকে ভালবেসে ইতিহাসের পাতায় রূপকথা হয়ে যিনি থেকে যাবেন।
(চলবে)