সপ্তডিঙা মধুকর নিয়ে পালতোলা জাহাজ ভাগীরথীর বক্ষে ভেসে চলেছে।
জাহাজে রয়েছেন বাংলার বণিক চাঁদ সওদাগর। ভাগীরথীর নিম্ন অংশ সরস্বতী হুগলি হয়ে যাবে সমুদ্রের মোহনায়। বানিজ্য চলবে সিংহল, সুবর্ণদ্বীপ, কম্বোজ, বালির সঙ্গে।
হয়ত মাঝে মাঝে হুগলি নদীর ঘাটে খানিক জিরিয়ে নেওয়ার জন্য থামবেন। রেখে যাবেন গল্পের উৎস।
সমুদ্রের মোহনা দিয়ে যেমন চাঁদ সদাগর ভিনদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন তেমনি ভিনদেশের বণিকরা পালতোলা জাহাজে এসে বাংলার ঘাটে ঘাটে নোঙর ফেলেছিল। ব্যবসার জন্য।
আর্মেনিয়ানরা হুগলি থেকে এই পথ ধরেই কলকাতায় এলেন। তাঁদের পদচিহ্ন রয়ে গেল সারা শহর ও গঙ্গাবক্ষে।
হাওড়া ফেরিঘাটের দক্ষিণ পাশে তৈরি হয় আর্মেনিয়ান ঘাট।
তৈরি করেছিলেন একজন বিত্তবান আর্মানি। নাম ম্যানুয়েল হাজার মালিয়াঁ। ১৭৩৪ সালে এই ঘাট তৈরি হয়েছিল। এই অঞ্চল থেকে ১৮৭৩ সালে প্রথম ট্রাম চলা শুরু হয়।
ঘোড়ায় টানা ট্রাম শিয়ালদহ ডালহৌসি-কাস্টমস হয়ে আর্মেনিয়ান ঘাটে এসে দাঁড়াত। এই ঘাটের পাশ থেকে স্টিমার ছেড়ে পৌঁছে যেত তমলুক, কোলাঘাট আর ঘাটাল।
আবার স্ট্র্যান্ড রোডের উল্টোদিকে চলে গেছে ব্রাবর্ন রোড।
আজকের ব্রাবর্ন রোড, চিনা বাজার অঞ্চলে ছিল আর্মেনিয়ানদের প্রধান বসতি। এখানে ছিল একটি গোরস্থান। কলকাতার ইতিহাসে এই গোরস্থানটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানে পাওয়া গিয়েছিল কলকাতা শহরের প্রাচীনতম সমাধিলিপি।
রেজাবিবি। একজন আর্মানি মহিলা। ১৬৩০ সালে ২১ জুলাই মারা যান। প্রাপ্ত প্রাচীন সমাধিলিপিটিতে রেজাবিবির নাম ও মৃত্যুর সাল, তারিখ খোদিত আছে। অনেক ইতিহাসবিদ এই ফলকটি আর্মেনিয়ানদের কলকাতা বাসের প্রাচীনত্বের প্রমাণ বলে মনে করেন।
সাবেক কলকাতার সিমলা এলাকাতেও আর্মেনিয়ান বণিকরা থাকতেন। তাঁদের পরিবারের একজন ছিলেন সুকিয়াস বিবি। তিনি রাস্তা তৈরিতে অনেক টাকা দান করেন। সেই কারণে রাস্তার নাম হয় সুকিয়াস স্ট্রিট। আবার অনেকের মতে আর্মেনিয়ান পিটার সুকিয়াস খুবই বিত্তশালী ছিলেন। দান-ধ্যান করে তাঁর নাম হয়েছিল। ফলে তাঁর নামানুসারে রাস্তার নাম হয় সুকিয়াস স্ট্রিট।
আর্মেনিয়ানরা চুঁচুড়া থেকে কলকাতা এলেন। কলকাতা এসে বসতি স্থাপন করলেও এখানে তাঁদের সমবেতভাবে উপাসনা করার জন্য কোনো চার্চ ছিল না। ১৭০৭ সালে ইংরেজদের সহায়তায় আর্মেনিয়ানরা তাঁদের প্রধান বসতি অঞ্চলে গোরস্থানের পাশেই তৈরি করে একটি গির্জা বা চার্চ। এটিই কলকাতার প্রাচীনতম চার্চ। ইংরেজদের প্রথম গির্জা সেন্ট অ্যান চার্চ স্থাপিত হয় তার ঠিক দু'বছর পরে ১৭০৯ সালে।
কলকাতার এই প্রাচীন চার্চটি প্রথমে ছিল কাঠের তৈরি। ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৭২৪ সালে আগা নাজার নামে এক আর্মানি ব্যবসায়ীর টাকায় পারস্যের স্থপতি গাভোনের নকশা অনুযায়ী পাকা চার্চ তৈরি করা হয়। চার্চটি 'আর্মানিয়ান হোলি চার্চ অফ নাজারেথ' নামে পরিচিত হয়।
১৭৩৪ সালে ম্যানুয়েল হজরমল নামে এক ব্যবসায়ী চার্চের চূড়াটি নির্মাণ করান। জমি দিয়েছিলেন কেনানেনটেক ফানুস নামে আর এক আর্মেনিয়ান। পরে লোক সংখ্যা বাড়লে ট্যাংরা ও পার্ক সার্কাস অঞ্চলে আর্মেনিয়ানদের আরও দুটি চার্চ তৈরি হয়। ট্যাংরার সেন্ট মেরিজ চ্যাপেল আর পার্ক সার্কাসের সেন্ট গ্রেগরি চ্যাপেল। সেন্ট গ্রেগরি চ্যাপেলকে আর্মেনিয়ানরা ছোট চার্চ নামে ডাকেন।
আর্মেনিয়ানরা ২৫ ডিসেম্বরের বদলে ৬ জানুয়ারি খ্রিষ্ট জন্মোৎসব পালন করেন। তাঁরা এই দিনটিকে 'ওয়াটার ব্লেসিং ডে' নামে পালন করে থাকেন। অর্থাৎ দিনটি যিশুর ব্যাপ্টিজম বা দীক্ষা গ্রহণ করার দিন। যিশু খ্রিস্টের সঠিক জন্ম তারিখ জানা যায় না। তাই চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৬ জানুয়ারি দিনটিকে যিশুর জন্ম দিবস ধরে নিয়ে বড়ো দিন হিসেবে পালন করা হত। আর্মেনিয় সম্প্রদায় ৩২১ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টাব্দ ধর্ম গ্রহণ করেন।
১৭ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্যে 'প্যাগান উৎসব' চলত। 'প্যাগান' বলতে মূলত বহু ঈশ্বরবাদীদের বোঝানো হয়। তেমনি একটি প্যা ধর্মোৎসব ছিল উইন্টার সলস্টিস। এদিন সূর্যদেবতার আরাধনা করা হয়। এই প্যাগান উৎসব তখন খ্রিষ্টানরাও পালন করতেন।
রোমান সম্রাট খ্রিষ্টীয় ধর্মে দীক্ষিত হলে রাজ্যে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। খ্রিষ্টানদের পাগান উৎসব থেকে প্রতিহত করতে বড়োদিন ২৫ ডিসেম্বর নিয়ে আসেন। ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় এই ঘটনায় কোনরকম সমস্যা হয় নি। অন্যদিকে আর্মেনিয়ানরা চিরকাল তাদের চার্চের নিয়ম অনুসারে চলেন বলে আর্মেনিয়াতে আজও ৬ জানুয়ারি ক্রিসমাস পালনের রীতি টিকে রয়েছে। প্রথম প্রাচীনতম চার্চ তৈরির কৃতিত্ব ছাড়াও কলকাতার দ্বিতীয় পুরনো কলেজ তৈরির শিরোপা কিন্তু এই আর্মেনিয়ানদেরই।
( চলবে)