কলকাতার প্রথম ভিনদেশী বণিক

"প্রথম প্রেম ঘুচে যাওয়ার যন্ত্রণাকে নিয়ে/ কান্না চেপে ঘুরেছিলাম তোমারই পথ দিয়ে" আর্মেনিয়ান ঘাট দিয়ে গঙ্গা পেরিয়ে ব্রাবোন রোড ধরে একাকি হেঁটেছি। ব্যস্ত বড়বাজার, চিনাবাজার পেরিয়ে এসপ্ল্যানেডের বড়ো বড়ো ইমারত গ্র্যান্ড হোটেল, ফেয়ারলন, কেনিলওয়ার্থের মাঝে আবার নতুন করে প্রেমে পড়েছি। "এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু"। প্রেয়সী কলকাতা। বুকের ভিতরে নানান গল্প জমিয়ে রেখেছে।

ষোড়শি বলব, না উদ্ভিন্ন যৌবনা বলব, নাকি প্রৌঢ়া? তবে তিলোত্তমা আজও সুন্দরী, প্রাণোচ্ছ্বল। ভিনদেশী ষোড়শীর প্রেমের টানে নিজেকে উজাড় করেছে। ভালোবাসার বাহুডোরে বাঁধা পড়ে এখানে থেকে গেছে।

সুতানটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা এই তিনটি জনপদ তখনও হাত ধরাধরি করে শহর হয়ে ওঠেনি। সদ্য কৈশোরে পা দিয়েছে। সেই সময় সুদূর মহাদেশ ইউরোপ এবং এশিয়ার সীমান্তের ককেশীয় পার্বত্য অঞ্চল থেকে এক জাতি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। প্রথম ইউরোপিয় জাতি হিসেবে পার্সিয়া, আফগানিস্তান, তিব্বতের পথ ধরে এসে ভারতের উপকূলে নোঙর ফেলে। এঁরা ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী। জাতিতে আর্মেনিয়।

কলকাতার বড় বড় ইমারতের বেশ কিছু আর্মেনিয়ানদের তৈরি। কলকাতার রাজপথে আজও এঁদের পদচিহ্ন রয়ে গেছে। কলকাতার ইতিহাস রচনায় আর্মেনিয়ানদের অবদান কম নয়। বর্তমানে তাঁরা কোথায় আছেন এবং তাঁদের ইতিহাস কী? চলুন সময়ের সরণী ধরে একটু পিছনের দিকে হাঁটি। কলকাতার আর্মেনিয়ানদের সম্পর্কে জানি।

আর্মেনিয়ানদের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্কের ইতিহাস বেশ পুরনো। পারস্যের উৎকৃষ্ট সিল্ক, পশম, আয়না, বন্দুক এদেশে আমদানি করতেন। বদলে দেশ থেকে নিয়ে যেতেন সুতির কাপড়, মশলা আর মুক্তো। প্রাথমিকভাবে সাধারণ বণিক হিসেবে এদেশে এলেও তাদের মধুর ব্যবহারে মুঘল রাজ পুরুষদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে।

শোনা যায়, সম্রাট আকবরের মেরিয়ম নামের এক আর্মেনিয়ান স্ত্রী ছিলেন এবং সেই সুবাদে মুঘল দরবারে আর্মেনিয়ানদের কুটুম্বিতা ছিল সর্বজনবিদিত। সম্রাট আকবরের আহ্বানেই আগ্রায় তৈরি হয় আর্মেনিয়ানদের প্রথম কুঠি। ঔরঙ্গজেবও নাকি খুব তুষ্ট ছিলেন আর্মেনিয়ানদের প্রতি। বাংলায় মুর্শিদাবাদের কাছে সৈয়দাবাদে বসবাসের ছাড়পত্র মিলেছিল আর্মেনিয়ানদের। শুধু তাই নয়, মুঘল সম্রাট তাদের বানিজ্য খাজনা ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে করেছিলেন ৩.৫ শতাংশ।

ইংরেজ, ওলন্দাজ, ফরাসি ইত্যাদি ইউরোপিয়ান বণিকদের সঙ্গেও আর্মেনিয়ানদের অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। হুগলির গঙ্গার পাড় জুড়ে গড়ে উঠেছিল একাধিক ইউরোপিয় বাণিজ্য কুঠি বা ট্রেড পোস্ট। আর্মেনিয়ানরা ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে ওলন্দাজ শাসিত হুগলিতে আসেন এবং ব্যবসা শুরু করেন। ১৬৯৭ সালে হুগলির আর্মানিটোলায় তৈরি হয় বাঙলার দ্বিতীয় চার্চ - "আর্মেনিয়ান চার্চ অফ সেন্ট জন দ্য ব্যাপটিস্ট"।

পলাশীর যুদ্ধের পর কলকাতা শহরের গুরুত্ব বাড়লে আর্মেনিয়ানরা হুগলির পাট চুকিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। সুতানটি, গোবিন্দপুর, কলকাতা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কিনতে আর্মেনিয়ানরা সাহায্য করেছিলেন। তেমনি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে আর্মেনিয়ানদের বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকার রক্ষার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৬৮৮ সালের ২২ জুন।

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে স্বাক্ষর করেন স্যার জোসিয়া চাইল্ড আর আর্মেনিয়ানদের পক্ষ থেকে ছিলেন খোজা সারহাদ আর খোজা ফানুস। চুক্তির শর্ত অনুসারে ভারতের যে কোন জায়গায় যদি অন্তত চল্লিশজন আর্মেনিয়ান বাস করে, তবে তাঁদের জন্য একটি চার্চ নির্মাণ করে দিতেই হবে এবং সেই চার্চের যাজককে ৫০ পাউন্ড বেতন দিতে হবে। এরপর তৈরি হয় কলকাতার প্রাচীনতম খ্রিস্টিয় গির্জা।

(চলবে)

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...