কল্লোলিনী কলকাতা। সারা ভারতের কাছে সে সাংস্কৃতিক রাজধানী নামেই পরিচিত। সেই কলকাতাতে সিনেমা, থিয়েটার, গান, নাটক নিয়ে চর্চা বহু যুগের। এখানকার মানুষ শুধু রাজনীতি নয় ভালোবাসে সংস্কৃতি নিয়ে থাকতে। শহরের বুক চিরে চলে যাওয়া টিং টিং শব্দে ট্রামটাও যেন এই শহরের ইতিহাস বহন করে। এই ট্রাম যাত্রাতেই কত কবি, কত সাহিত্যিক, কত নাট্যকার এই শহরের ইতিহাস সৃষ্টি করার স্বপ্ন দেখেছে। তা সে হোক বাঙালি, বা ব্রিটিশ কিংবা রাশিয়ান।
সালটা ১৭৯০। সে সময়ে কলকাতা শহরে ব্রিটিশ থাকবে সেটা আশানুরূপ কিন্তু রাশিয়ান! সে সময় কলকাতা শহরে রাশিয়ানদের উপস্থিতি না থাকারই কথা। তবু এমন এক বিশিষ্ট রাশিয়ান ব্যক্তিত্বের উপস্থিতির প্রমান মেলে শহরের গেজেটে। বিশিষ্ট বলতেই হয় কারণ তাঁর হাত ধরে তিলোত্তমা তার প্রথম পেক্ষাগৃহ পেয়েছিল ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’।
গেরাসিম লেভেদেভ। ১৭৪৯ সালে রাশিয়ার ইয়ারোস্ল্যাভ শহরে জন্ম নেন তিনি। তাঁর বাবা ছিলেন গির্জার প্রধান বাদ্যকার। বাবার কাছেই তাঁর প্রথম গানের হাতেখড়ি। গির্জায় গান করতে করতে থিয়েটারের প্রতি মন যায় তাঁর। থিয়েটারে অভিনয়ের জন্য লেভদেভ ধীরে ধীরে ইংরেজি, জার্মানি, স্প্যানিশ, ফরাসি সমস্ত ভাষা শেখেন। বড় হয়ে ইংরেজি সাহিত্য চর্চা করতে ইংল্যান্ড যান লেভদেভ। সেখান থেকে ১৭৮৫ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ ‘রডনি’-তে করে মাদ্রাজে আসেন। সেখানে দু বছর কাটিয়ে ১৭৮৭ সালে আসেন কলকাতায়।
কলকাতার মধ্যে প্রাণ খুঁজে পান লেভদেভ। বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি তাঁকে আকর্ষন করে। নিজেকে গীতীকার, বাদ্যকার নাট্যকার হিসেবে মেলে ধরার সুযোগ পান তিনি। তিনি বাংলা ভাষা শেখেন। শেখেন বাংলা গানও। বলা হয় লেভদেভই প্রথম অভারতীয় যিনি কোনও বিদেশী বাদ্যযন্ত্রে প্রথম বাংলা গানের সুর বাজান।
১৭৯১ সালে ভারতীয় শিক্ষক গোলকনাথ দাসের কাছে তিনি বাংলা ব্যকারন, সংস্কৃত, হিন্দি এই সব ভাষার জ্ঞান লাভ করেন। তারপর তৎকালীন ২৫, দুমতলা বর্তমানে ৩৭, এজরা স্ট্রিটে খোলেন শহরের প্রথম প্রেক্ষাগৃহ ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’। বাংলা ঘরানায় তৈরি এই প্রেক্ষাগৃহ নজর ও মন কেড়েছিল সাহেব থেকে ‘নেটিভ’-দেরও। প্রথম নাটক হয়েছিল বাংলাতেই। তার অনুবাদ করেছিলেন তিনিই। ‘দি ডিসগাইজ’ ও ‘লাভ ইস দি বেস্ট ডক্টর’ নামে দুই নাটক ২৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল। নাটকের সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন লেভদেভ ও বাঙালী কবি ভারতচন্দ্র রায়।
ক্যালকাটা সোসাইটিতে ছড়িয়ে পড়ে লেভদেভের নাম। সেই সঙ্গে বাঙালী মহলেও তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। মডার্ন ইন্ডিয়ান থিয়েটারের অন্যতম পথিকৃৎ লেভদেভের সেই প্রেক্ষাগৃহ অবশ্য বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। আগুনে পুড়ে যায় থিয়েটারটি। ধীরে ধীরে ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন তিনি। ১৭৯৭ সালে তাঁকে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সেন্ট পিটর্সবার্গে গিয়েও বাংলার মাটিকে একফোঁটা ভোলেননি লেভদেভ। বরং সেখানে গিয়েও ভারতীয় এবং বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বিদেশী ভাষার মিশ্রন নিয়ে কাজ করে। লন্ডনে তিনি এর ওপর ‘আ গ্রামার ওফ পিওর অ্যান্ড মিক্সড ইন্ডিয়ান ইস্ট ডায়ালেক্ট' নামে ১৮০১ সালে একটি বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেন। তাঁর মৃত্যু আগে পর্যন্ত তনি এই বিষয়ে নিরলস কাজ করে গেছেন। সে দেশের গ্রন্থাগারে এখনও সযত্নে রক্ষিত আছে সেই বই। ১৮১৭ সালের ২৭ জুলাই তিনি সেন্ড পিটার্সবার্গে মারা যান।