লোকাচার, লৌকিক দেবতার পুজো পাঠ; যেকোনও জনজাতির ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। কোনও কোনও অঞ্চলে, বিশেষ বিশেষ কিছু লোকাচার দেখতে পাওয়া যায়। সেই নির্দিষ্ট লোকাচারগুলো ঐ অঞ্চলের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে। বাংলার লৌকিক ইতিহাস বড্ড সমৃদ্ধ, বহু জনজাতি বাংলায় এসেছে, সংস্কৃতির অদল-বদল হয়েছে। বাংলার নানান প্রান্তে নানা জনজাতির বসবাস, ফলে বাংলার লোকায়েত দর্শনে নানান দেবদেবীর কথা জানা যায়।
প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা পেতে, রোগ বালাই থেকে রক্ষা পেতে, বিপদ সংকট থেকে রেহাই পেতে মানুষ নানান দেবতার পুজো করতে শুরু করে, সেই সব দেবতারাই হয়ে উঠেছেন বাংলার লৌকিক দেবতা।
অজানা জ্বর, ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া ইত্যাদির প্রকোপ বাড়লে, জ্বরাসুরের পুজো করে পল্লী বাংলা। মানুষ তো তুচ্ছ! লব, কুশকে বাঁচাতে স্বয়ং সীতাকেও জ্বরাসুরের পুজো করতে হয়েছিল। সে গল্পে আসছি তার আগে বরং জ্বরাসুরের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে নেই...
বাংলার লৌকিক দেবতাদের মধ্যে অন্যতম হলেন জ্বরাসুর। জ্বর নাশের বিচিত্র দেবতা হলেন জ্বরাসুর। অনুররূপী এই জ্বরের দেবতার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য লোকসমাজ এর পুজো করেন। জ্বরাসুরের দেহের অবয়ব ভারী বিচিত্র ধরনের। এর গায়ের রঙ ঘন নীল। তিনটি মাথা, নয়টি চোখ, ছয়টি হাত ও তিনটি পা নিয়ে জ্বরাসুর বিরাজ করেন। অসংখ্য থানে শীতলা, মনসা, দক্ষিণ রায়, আটেশ্বর প্রভৃতি লৌকিক দেবদেবীর সঙ্গে জ্বরাসুর পুজো পান। জ্বরাসুরের মূর্তি পূজার প্রচলন খুব বেশি এবং শীতলার থানে বা মন্দিরে জ্বরাসুর নিত্যপুজো পান। পাল যুগ থেকে বাংলায় শীতলা মূর্তির সঙ্গী হতে শুরু করে জ্বরাসুর। হিন্দু পুরাণ মতে, জ্বরাসুর হলেন জ্বর-দেবতা এবং শীতলা দেবী হলেন তার স্ত্রী।
শীতলা-জ্বরাসুর বাঙালির লৌকিক সংস্কৃতিতে খুবই জনপ্রিয়। জ্বর হল এক বিশেষ রোগ, আর অসুর অর্থ দৈত্য,দানব। এই দুই মিলে জ্বরাসুর। দুটি শব্দের সন্ধির ফলে এর উৎপত্তি লাভ করেছে। জ্বরাসুর মানে জ্বরের দৈত্য। জ্বরাসুর যুবকের ছদ্মবেশ ধারণ করেন এবং জ্বর ছড়িয়ে দেন। তাকে পুজো করে সন্তুষ্ট করতে পারলেই জ্বর কমে যায়। উত্তর ভারত এবং পূর্ব ভারতের বসন্ত এবং জ্বর রোগের রক্ষাকর্তা হিসেবে যথাক্রমে শীতলা ও জ্বরাসুর পুজিত হন। বাংলার রোগ বালাই থেকে মুক্তি পেতে এমন অনেক দেবতারই আরাধনা করা হয়। যেমন ওলাওঠা বা কলেরা থেকে নিরাময়ের জন্য ওলাইচন্ডি দেবীর পুজো করা হয়।
পেট খারাপ হলে নিশ্চয়ই অর্থোপেডিকের কাছে দেখাতে যান না, জ্বরজ্বারি হলে গাইনোকলজিস্ট দেখাবেন না, ঠিক তেমন দেবতাদের ক্ষেত্রেও। সব রোগের আলাদা বিশেষজ্ঞের মতোই দেবতারদের ক্ষেত্রে অনেকটা সে রকমই। আলাদা রোগের আলাদা ভগবান। জ্বর হলে জ্বরাসুর, বসন্ত হলে শীতলা, কলেরা হলে ওলাবিবি আর খোস-পাঁচড়া হলে পাঁচু ঠাকুরের থানে যেতে হবে।
এক কিংবদন্তি মতে মনে করা হয়, শিবের ধ্যান করার সময় কপালের ঘাম থেকে জ্বরাসুর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দেবতাদের জন্য জ্বরাসুর ছিলেন ত্রাসের কারণ। একবার বিষ্ণু জ্বরাসুরের জ্বরে পড়েন। তিনিই জ্বরাসুরকে হত্যা করেছিলেন। তিনি সুদর্শন চক্র ব্যবহার করে জ্বরাসুরকে তিন টুকরো করেছিলেন।
এরপরেই জ্বরাসুর ব্রহ্মার দ্বারা পুনঃজীবিত হন। ব্রহ্মা তার তিনটি অংশ যোগ করেন। কিন্তু ততদিনে তিনটি অংশের প্রতিটির মাথা ও অঙ্গ গজিয়ে গিয়েছিল। যার ফলে জ্বরাসুর তিনটি মুখ, তিন পা এবং একযোগে সব দিক থেকে যাওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা পেয়েছিল। পরবর্তীতে তিনিই শীতলার স্বামী হন।
বাংলার বৌদ্ধ মন্ত্রযান, বজ্রযান ঐতিহ্যে জ্বরাসুর রয়েছে। বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে, জ্বরাসুর কখনও কখনও রোগের বৌদ্ধ দেবী পর্ণশর্বরীর স্বামী হিসাবে বিবেচিত হন। কিছু ছবিতে এই দেবতাগুলি বৌদ্ধ দেবী এবং রোগের ধ্বংসকারী বজ্রযোগিনীর, রাগ থেকে পালাতে দূরে উড়ে যাচ্ছে দেখানো বলে। প্রাচীন তন্ত্রপুঁথিতেও জ্বরাসুরের উল্লেখ রয়েছে। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে গিয়েছেন সাহিত্যিক তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। 'তারানাথ তান্ত্রিক' গ্রন্থের এক আখ্যানে তিনি জ্বরাসুরের পুজোর কথা বিস্তারিত লিখেছিলেন।
বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মের মধ্যে অনেক কিছুরই আদান প্রদান হয়েছে। বাংলা থেকে তন্ত্র বৌদ্ধাঞ্চলে গিয়েছে। তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশেলে ফের ফিরে এসেছে বাংলায়। সেই কারণেই বাংলার তন্ত্রে বৌদ্ধধর্মের ছোঁয়া পাওয়া যায়। হয়ত দুটোর উৎপত্তিই একই তত্ত্ব থেকে, তন্ত্র তত্ত্বের মতোই হিন্দু লৌকিক দেবদেবীর সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের একাধিক দেবদেবীর সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন শীতলা দেবীর সঙ্গে প্লেগের বৌদ্ধ দেবী পর্ণশর্বরীর আকৃতিগত অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। জ্বরের বৌদ্ধ দেবতা হয়গ্রীব ও হিন্দু জ্বরাসুর প্রায় অনুরূপ।
অন্য একটি মতে, জ্বরাসুর হলেন বসন্ত রোগের দেবী মা শীতলার পুরোধা সৈনিক। কিন্তু জ্বরাসুর কি শুধুই শীতলার অনুগত সেনাধ্যক্ষ? জ্বরাসুরের আলাদা মূর্তি ছিল। হরিবংশ ও বিভিন্ন গ্রন্থ জানাচ্ছে, জ্বর-দেবতার তিন পা, তিন মাথা, ছয় বাহু ও নয়টি চোখ। কেশ স্বর্ণাভ, নখস্পর্শ বজ্রাধিক। তার পুজোর জন্য আলাদা মন্ত্রও ছিল,
'কৃশপিঙ্গললোমক্ষং কৃষ্ণাঞ্জনচয়োপমম,
প্রলয়াম্বুদনির্ঘোষং সর্বভূতভয়াপহম।'
অষ্টাদশ শতকে মানিকরাম গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা 'শীতলামঙ্গল' কাব্যে জ্বরাসুরের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। মানিকরামের 'ধর্মমঙ্গল' বিখ্যাত, কিন্তু শীতলা, জ্বরাসুরদের নিয়েও তিনি মঙ্গলকাব্য লিখে গিয়েছেন।
শীতলামঙ্গলে দেখা যাচ্ছে, শীতলা এক দিন তাঁর সৈন্যসামন্তদের ডেকে বললেন, ''চলো, মুনিদের আশ্রমে যাই। লব, কুশকে জ্বরে ভোগাতে হবে। তা হলেই মর্তে আমার মাহাত্ম্য প্রচারিত হবে।'' শীতলার সঙ্গী হলেন জ্বরাসুর এবং চামুণ্ডাল। ত্বকে চুলকানি ও প্রদাহের জন্য চামুণ্ডাল দায়ী হন। বিষ-বসন্ত সবাই প্রথমে বলল, ''জানকী এমনিতেই অনেক দুঃখ বোধ করেছেন। আবার লব, কুশকে অসুস্থ করে দেবেন?''
কিন্তু শীতলা ছাড়লেন না। এক থুত্থুড়ে বুড়ির ছদ্মবেশে তিনি বাল্মীকির আশ্রমে চললেন। তাঁর হাতে এক রঙিন ঝুড়ি, সেখানে হাম ও বসন্তের গুটি হাম ও গুটি বসন্ত চাপা দেওয়া।
লব, কুশ তপোবনে খেলতে খেলতে ছুটে এল, ''এই বুড়ি, তোমার ঝুড়িতে কী আছে?'' বুড়ি উত্তর দিল, ''এমন কিছু নয়, ডালের দানা।'' তপোবনের শিশুরা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ''মিষ্টি খেতে তো? তা হলে আমাদের দাও।'' বুড়ি বলল, ''এমনি এমনি কিছু নেওয়া যায় না গো ছেলেরা।'' লব, কুশ দুই ভাই তখন ঝুড়ি ধরে টানাটানি আরম্ভ করল, ''আমাদের দিতেই হবে। জানো, আমরা কে?'' বুড়ি উত্তর দিল, ''দুর, রামচন্দ্রের ছেলে দুটো মহা অসভ্য তো! মরবি, মরবি।'' লব, কুশেরা সেই ডালের দানা খেতে শুরু করল। বুড়ি অন্তর্হিত হল। জ্বরাসুরকে নির্দেশ দিল, ''যাও, এ বার ওদের আক্রমণ করো। লব, কুশের গলা ভাল ভাবে চেপে ধরো, যাতে কথা বলার সামর্থ্যও না থাকে।''
অসুস্থ শিশুদের নিয়ে তপোবনের মহিলারা কাঁদছেন। সীতা মাঝে মাঝে মূর্ছিত হয়ে পড়ছেন, ফের আক্ষেপ করছেন, ''এর চেয়ে লঙ্কায় রাক্ষসীরা আমাকে মেরে ফেলল না কেন? সেও ভাল ছিল।'' নারদ এলেন, হনুমানকে ডাকা হল। হনুমান দেবচিকিৎসক ধন্বন্তরীকে পিঠে করে উড়িয়ে নিয়ে এলেন। ধন্বন্তরী সীতা ও অন্যদের বললেন, ''আপনারা শীতলার পুজো করুন। বলুন, তুমি ভয়বিনাশিনী ভদ্রকালী, তুমিই শিবের অর্ধাঙ্গিনী মহেশ্বরী, তুমি শুভদায়িনী মঙ্গলা, তুমিই জয়দাত্রী জয়ন্তী। মা, তুমিই পতিতপাবনী, তুমিই আদ্যাশক্তি।'' মন্ত্রপাঠ করে আক্রান্ত শিশুদের নিমের জলে স্নান করালেন ধন্বন্তরী। লব, কুশ ও অন্যরা সেরে উঠল। মর্তধামে শীতলা, জ্বরাসুরের পুজো প্রচারিত হল।
এই মঙ্গলকাব্যে রামচন্দ্রের সন্তানরাও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক দিকে সর্বভারতীয় রাম-সীতা-লব-কুশ, অন্য দিকে সেই ভারতীয়ত্বে নিজের চেনা রোগের অভিজ্ঞতা বুনে দেওয়া, অন্য আরেক লৌকিক রাম; এখানেই বাঙালির নিজস্বতা।
পৃথিবীতে জ্বর কী ভাবে এল, তা নিয়ে চরকসংহিতায় দক্ষযজ্ঞের কাহিনী রয়েছে। দক্ষ তাঁর যজ্ঞে শিবকে আহুতি দেননি, শিব রেগে তৃতীয় নয়নে ক্রোধাগ্নি ঝরালেন।
সেই আগুন থেকে ভূত-প্রেত বেরিয়ে দক্ষের যজ্ঞ ধ্বংস করল। শেষে তারা শিবকে জিজ্ঞেস করল, ''এবার কী করব?'' শিব বললেন, ''কিছু করতে হবে না। মানুষের শরীরে জন্ম, মৃত্যু আর তার মাঝে কোনও কোনও সময় উত্তাপ ছড়িয়ে জ্বর রূপে থাকবে তোমরা।'' চরকের আমলে দেবীমাহাত্ম্য সে ভাবে প্রচারিত হয়নি। তাই দক্ষকন্যা সতীর অপমান ও দেহত্যাগের কথা নেই। পরে দেবীমাহাত্ম্য জনপ্রিয় হল, জ্বরের সঙ্গী শীতলাকে 'তুমিই জয়ন্তী, তুমিই আদ্যাশক্তি' বলে বাংলার কবি প্রণাম করতে শেখালেন। শিব এবং মহামায়াই সব নন। জ্বর নিয়ে বাংলার কবিরাজি মহলে আরও একটি গল্প ছিল।
দৈত্য বাণরাজার মেয়ে উষার প্রেমে পড়েছে শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ। রাজকন্যার শয়নগৃহে সেই তরুণকে বাণের সেনারা বন্দি করে। শ্রীকৃষ্ণ কী আর করবেন? যুদ্ধ ব্যতিরেকে উপায় নেই। প্রবল যুদ্ধ, শিব এগিয়ে এলেন তাঁর ভক্ত বাণের সম্মান রক্ষায়। ছেড়ে দিলেন রুদ্র-জ্বর। সৈন্যসামন্ত থেকে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও আক্রান্ত হলেন সেই রোগে। তখন কৃষ্ণ নিজের শরীর থেকে সৃষ্টি করলেন বিষ্ণু-জ্বর। অতঃপর দুই জ্বরে ভয়াল সংগ্রাম, রুদ্র-জ্বর পরাস্ত হল। বিষ্ণু-জ্বর ফিরে এল শ্রীকৃষ্ণের শরীরী তূণে। রুদ্র-জ্বরকেও ক্ষমা করে দিলেন কৃষ্ণ, ''তুমি এ বার শুধু জ্বর হিসেবে ঘুরে বেড়াও।'' হয়ত সেই জ্বরই লৌকিক জ্বরাসুর। এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি পুরাণ আর লোকাচার এখানেই মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। পৌরাণিক কাহিনী থেকেই পল্লী বাংলার লৌকিক দেবদেবতাদের জন্ম হয়েছে। আদপে রোগ বালাই, আপদ বিপদ থেকে মুক্তি পেতে মানুষের ভয় ও শঙ্কার মিশেলে এদের জন্ম হয়েছে। মঙ্গলকামনায় আজও এদের পুজো করে চলেছে বাংলা।