রাসকথা: পর্ব-১ ভক্ত ও ভগবানের মহামিলন

রাস হল, ভক্তের সঙ্গের ভগবানের অর্থাৎ জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন। কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমাই রাসপূর্ণিমা নামে পরিচিত। কথিত আছে, শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলে, তিনি তাদের ইচ্ছা পূরণ করবেন এবং তাদের সঙ্গে রাসলীলা করবেন। সেই থেকেই শুরু হয় রাস লীলা। জনশ্রুতি রয়েছে, নবদ্বীপে চৈতন্যদেব রাধাকৃষ্ণের রাস উৎসবের সূচনা করেছিলেন। ফলে বলা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে রাসের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু চৈতন্যদেবের সন্ন্যাস গ্রহণের পর নবদ্বীপের বৈষ্ণব আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে নবদ্বীপে যে রাস উৎসবের সূচনা হয় তা অভিনব এবং বাংলার ধর্মীয় ইতিহাসে তা অদ্বিতীয়।

দুর্গা পুজো, কালী পুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো কেটে গিয়েছে, এবার রাস পূর্ণিমার পালা। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মনে করা হয়, এই দিন ভগবান শিব ত্রিপুরাসুর রাক্ষসকে বধ করেছিলেন। তাই এই পূর্ণিমা ত্রিপুরী বা ত্রিপুরারি পূর্ণিমা নামেও পরিচিত। অন্য একটি কিংবদন্তি অনুসারে, এই দিনে ভগবান শ্রী হরি বিষ্ণু মৎস্য অবতার গ্রহণ করেছিলেন। পুরাণে শারদ রাস ও বসন্ত রাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র পরবর্তী সময়কালে বাংলায় রাস উৎসবের বহুল প্রচলন ঘটে।

7da60a5ba471384281bf70e989eba841

প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, এই দিন বৃন্দাবনের গোপিনী সকাশে রাধার সঙ্গে রাস উৎসবে মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। গোপিনীদের নাচ ও শ্রীকৃষ্ণের সুমধুর বংশীধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছিল বৃন্দাবন। শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণের এই মিলন উৎসবকে পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্যদেব নাম-সঙ্কীর্তনের মধ্য দিয়ে রাস মহোৎসবে প রিণত করেন। রাস-লীলা নিয়ে বেশকিছু মত প্রচলিত আছে। এরমধ্যে বহুল জনপ্রিয় দুটি মতনুযায়ী, কথিত আছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর শ্রীকৃষ্ণ পাপমোচন ও পূর্ণলাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পান। এই থেকেই শুরু হয় রাস মেলা। আবার অন্য মতে, দুর্গাপুজোর পর পূর্ণিমাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে লীলায় মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। আর সেই থেকেই কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে রাস-লীলা পালিত হয়ে আসছে।

'রস' থেকে 'রাস'-র উৎপত্তি। রস শব্দের অর্থ আনন্দ, দিব্য অনুভূতি, দিব্য প্রেম বা রস অর্থে সার। তৈত্তিরীয় উপনিষদে রস সম্পর্কে বলা হয়েছে রসো বৈ সঃ, এখানে ব্রহ্ম রসকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। বৈষ্ণব দর্শনে রস বলতে মধুর রসকেই বোঝানো হয়েছে। রাস কথাটির আভিধানিক অর্থ হল নারী-পুরুষের হাত ধরাধরি করে মণ্ডলাকারে নৃত্য। যাকে বলা হয় 'হল্লীবক" নৃত্য। রাস পূর্ণিমাতেই কৃষ্ণলীলা করেন। শ্রীকৃষ্ণ শারদপূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনের যমুনাতটে গোপিনীদের আহ্বান করেন এবং তাদের সঙ্গদান করে, অর্থাৎ দিনটি বৃন্দাবনে গোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের লীলা করার দিন। লীলা মানে নৃত্য। বৈষ্ণবদের কাছে রাস আসলে ভক্ত এবং ভগবানের মিলন উৎসব। এক অসামান্য আনন্দ উৎসব। আবার রাস শব্দের আরেক অর্থ ধ্বনি, শব্দ, বাক্য, কোলাহল, বিলাস, ক্রীড়া এবং অনেকের সঙ্গে একসঙ্গে মিলিতভাবে আনন্দঘন নৃত্যবিশেষ।

রাসলীলা, রাস অর্থাৎ আনন্দের অনুভূতি আর লীলা মানে দৈবিক কার্য্য। রাসলীলা একপ্রকার বিশেষ নৃত্য, যা শ্রীকৃষ্ণ, রাধারানী গোপীবৃন্দ সহ করেছিলেন। এককথায়, রাস হল, দৈবিক নৃত্য। পদ্মপুরাণে শারদরাস ও বাসন্তীরাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বাসন্তীরাস এবং শ্রীমদ্ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণে শুধুমাত্র শারদরাসের বর্ণনা আছে। বালচরিতে রয়েছে, কৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে হল্লীশনৃত্য করেছিলেন। হল্লীশনৃত্যকে রাস নামে অভিহিত করা হয়। বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী, কৃষ্ণ গোপরমণীদের সঙ্গে রাস অনুষ্ঠান করেছিলেন। শ্রীধর স্বামী বলেছেন, বহু নর্তকীযুক্ত বিশেষ নাচের নাম রাস, রাসো নাম বহু নর্ত্তকীযুক্তে নৃত্যবিশেষঃ।

রাসলীলায় নাচ রাসনৃত্য নামে পরিচিতি। এই নাচ কখনও একক, কখনও দ্বৈত এবং কখনও দলবেঁধে হয়। রাস হল এক ধরনের বৃত্তাকার নাচ যা আট, ষোলো বা বত্রিশ জনে সম্মিলিতভাবে উপস্থাপনা করা যায়। নাচ পাঁচ ভাগে বিভক্ত, মহারাস, বসন্ত রাস, কুঞ্জরাস, দিব্যরাস ও নিত্যরাস। এর মধ্যে মহারাস সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ। নাচের বিষয়বস্তু হল রাধা ও তার সখীরা মিলে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম পর্ব, মান-অভিমান এবং শেষে মিলন দেখানো হয়। রাসনৃত্যে সাধারণত রাধা ও কৃষ্ণের ভূমিকা দেয়া হয় শিশুদের, যাদের বয়স পাঁচের কম। রাসলীলা শুরু হয় নট সঙ্কীর্তন দিয়ে। বাংলা, মৈথিলী, ব্রজবুলি কবিদের পদাবলি থেকে গান গাওয়া হয়।

নাচের মাধ্যমে দিব্যভাবের উদয় হয়। যমুনা তীরে সন্ধ্যে নামছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ যেন দিব্যভাবে উদ্ভাসিত। পূর্ণিমার রাতেই অনুষ্ঠিত হবে রসিক কৃষ্ণের রাসলীলা। গোপীরা অপেক্ষা করছে তাদের প্রাণপ্রিয়সখা শ্রীকৃষ্ণের ডাক আসবে। মিলনের আকাঙ্খায় মন ক্ষত-বিক্ষত। বৈষ্ণব পদাবলীর পদ, 'সই কে বা শোনাইলো শ্যামনাম, কানের মরমে পশিল গো আকুল করিল মোর প্রাণ'। জ্যোৎস্নায় কৃষ্ণ হাতে তুলে নিলেন মোহন বাঁশি। মধুর বংশীধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল যমুনার তীরে। সুর গোপীদের তীব্রভাবে আকর্ষণ করল। বাঁশির সুরে ছুটে চলল। কৃষ্ণ গোপীদের সঙ্গে নৃত্যগীতে নিবিষ্ট হলেন। গোপীরা কৃষ্ণের সান্নিধ্যলাভ করে ধন্য হল। শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীমতী রাধা ও গোপীবৃন্দের লীলা। শ্রীকৃষ্ণ হলেন স্বয়ং বিষ্ণু অবতার আর রাধা শ্রীকৃষ্ণরই পরাশক্তি। গোপীগণ হলেন সেই মুনি ঋষি গণ যারা অনেক সাধনা করেও ত্রেতাতে শ্রীরামের দর্শন পাননি। দ্বাপরে তাদের স্বপ্ন পূরণ হল। এখানেই ভক্ত ও ভগবানের মহামিলন হল।

শ্রীকৃষ্ণের জীবনী শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণে বর্ণিত রয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতের অন্যতম প্রধান অংশ হল রাসলীলা। শ্রীমদ্ভাগবতের বর্ণনা এবং প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, এই দিনেই বৃন্দাবনে গোপিনীদের সঙ্গে নিয়ে শ্রীরাধার সঙ্গে রাস উৎসবে মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। নদিয়ার শান্তিপুর ও নবদ্বীপে শুধু রাধা-কৃষ্ণ নয়, রাসে অন্যান্য দেব দেবীও পূজিত হন। কালী তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রায় টানা তিন থেকে চারদিন মহাসমারোহে পালিত হয় এই উৎসব। এমনকি উৎসবের শেষ দিন বের হয় শোভাযাত্রা। প্রথম দিন হয় প্রথম রাস, দ্বিতীয় দিনে হয় মাঝের রাস আর শেষ দিনে হয় ভাঙা রাস, এই ভাঙা রাস রাস উৎসবের অন্যতম সেরা অংশ।

0380018df74c16b342ed43c6f0c39b20

শ্রীমদ্ভাগবতের অন্যতম টীকাকার বিশ্বনাথ চক্রবর্তী রাসপূর্ণিমা সম্পর্কে বলেছেন, "নৃত্যগীতচুম্বনালিঙ্গনদীনাং রসানাং সমূহো রাসস্তন্ময়ী যা ক্রীড়া বা রাসক্রীড়া"। শ্রীমদ্ভাগবতের মতে, কৃষ্ণ যোগমায়াকে সমীপে গ্রহণ করেই রাস অনুষ্ঠান করেছিলেন। বস্ত্রহরণের দিন গোপিনীদের কাছে কৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, পরবর্তী পূর্ণিমা তিথিতে তিনি রাসলীলা করবেন। সেই পরবর্তী পূর্ণিমাই হল কার্তিক পূর্ণিমা।

"যখন করেন হরি বস্ত্রহরণ।
গোপীদের কাছে তিনি করিলেন পণ।।
আগামী পূর্ণিমাকালে তাঁহাদের সনে।
করবেন রাসলীলা পুণ্য বৃন্দাবনে।।"

শ্রীকৃষ্ণর সুরে অর্থাৎ বাশির সুরে মুগ্ধ হয়ে গোপিনীরা নিজেদের কাজকর্ম ভুলে সংসারের সকল মোহ ত্যাগ করে বৃন্দাবনে উপস্থিত হয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজেদের সমর্পন করেছিলেন। প্রথমে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। তাদের সংসার-ধর্ম পালন করার নির্দেশ। কিন্তু গোপিনীরা নিজেদের মতে অটুট ছিলেন। ভগবান ভক্তের ভক্তির বন্ধনে সব সময় আবদ্ধ থাকে। শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের ভক্তি দেখে, তাদের মনস্কামনা পূরণ করতে রাসলীলা আরম্ভ করেন। কিন্তু সেখানেই বাঁধল বিপত্তি। শ্রীকৃষ্ণ তাদের অধীন বলে ভেবে বসলেন গোপিনীরা। তাদের মনে গর্ব-অহংকারে জন্ম হল, তখনই শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান হয়ে গেল। শ্রীকৃষ্ণ যখন রাধাকে নিয়ে উধাও হলেন, তখন গোপিনীবৃন্দ নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। অহংকারের ফলে শ্রীকৃষ্ণকে তারা হারিয়ে ফেলেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ ত্রিজগতের পতি, তাকে কোনও বন্ধনে বেঁধে রাখা যায় না। গোপিনীরা শ্রীকৃষ্ণের স্তুতি করতে শুরু করেন। ভক্তের ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে, ভগবান গোপিনীদের মানব জীবনের পরমার্থ বুঝিয়ে দেন। তাদের অন্তর পরিশুদ্ধ করেন। জাগতিক ক্লেশ থেকে তারা মুক্তিলাভ করেছিলেন। এইভাবে রাসোৎসবের প্রচলন ঘটে।

কৃষ্ণে বিরুদ্ধহৃদয়া ইদমূচুঃ পরস্পরম্।
কৃষ্ণোহহমেতল্ললিতং ব্রজাম্যাক্যতং গতিং ||
অন্যা ব্রবীতি কৃষ্ণস্য মম গীতির্নিশাম্যতাং।
দুষ্ট কালিয়! তিষ্ঠাত্র কৃষ্ণোহহমিতি চাপরা।
বাহুনাস্ফোট্য কৃষ্ণস্য লীলাসর্ব্বস্বমাদদে ||
অন্যা ব্রবীতি ভো গোপা নিঃশঙ্কৈঃ স্থীয়তামিহ।
অলং বৃষ্টিভয়েনাত্র ধৃতো গোবর্দ্ধনো ময়া ||

আত্মা ও পরমাত্মা বা ঈশ্বরের মেলবন্ধন। পরমাত্মা রুপী কৃষ্ণের কৃপা লাভই উদ্দেশ্য। মহাজ্ঞানীরাও এজিনিস লাভ করতে পারেন না  কিন্তু গোপিনীরা কৃষ্ণের সৌন্দর্য্যের অনুরাগিণী হয়ে মহাজ্ঞান লাভ করল। ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হল। এখানেই রাসের মাহাত্ম্য, ভগবান ও ভক্তের মহামিলন।

আরও জানুন রাসকথা উৎসব সম্পর্কে: পর্ব - ২

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...