সময়টা বহু যুগ আগে। তখন লোকদেবতা আর অপদেবতার প্রসঙ্গ উঠত সুরক্ষা এবং ধ্বংসের ক্ষেত্রে। এমনকি অপদেবতার নাম নিতেও ভয় পেত সন্তানের মায়েরা। তেমনই একটা সন্ধ্যেবেলার গল্প। ছোট্ট ছেলেটা প্রথমে মাকে লুকিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ছিল। কিন্তু সন্ধ্যেবেলা এমনভাবে ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েদের বাইরে বেরোনো নাকি তাদের বিপদ দেখে আনতে পারে। মায়ের চোখ এড়ায়নি ছেলের বেরিয়ে যাওয়া। অবশেষে মাকে বলে বেরোতে যায় ছেলেটা। "মা আমি একটু বেরোচ্ছি।" দরজার বাইরে ছেলের পা পড়ছে দেখেই মায়ের বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এক ধমক দেন। "একদম বাইরে যাবি না এই ভর সন্ধ্যেবেলা।" এদিকে ছেলেটা জেদি। মায়ের কথায় মুখ ঝামটা দেয়। "সন্ধ্যেবেলা বের হতে গেলেই তুমি এমন করো কেন বলো তো, বাইরে গেলে কী হবে?" এদিকে সন্ধ্যেবেলা সেই অপদেবতার নাম নেওয়াও বারণ। যথারীতি ছেলের প্রশ্নের উত্তরে মা বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। ছেলে নাছোড়বান্দা। মা শুধু একটাই শব্দ উচ্চারণ করে, ছেলের প্রশ্নের উত্তরে। "কালসুং।"
বাংলাদেশের চাকমা সমাজে পুজিত হন এক অপদেবতা। তার নাম কালসুং। এই অপদেবতা শিজি নামে সাধারণ মানুষের কাছে বেশি পরিচিত। অনেকে মনে করেন শিজি নামটা সন্ধ্যেবেলার পর নেওয়া যায় না। ঠিক যেমন আমরা সাপকে সন্ধ্যেবেলা একসময় লতা বলে ডাকতাম, বাংলাদেশের চাকমা সমাজে এখনো সন্ধ্যেবেলা এই অপদেবতার নাম করতে হলে শিজির বদলে কালসুং হিসেবে ডাকা হয়। তাই সন্ধ্যেবেলা চাকমারা ওদের ছেলেমেয়েদের বাইরে বেরোতে নিষেধ করে। কারণ বাইরে গেলেই শিজি বা কালসুং-এর প্রকোপ এসে পড়বে সন্তানদের ওপর।
এই শিজি শব্দের মানে কি? চাকমাদের শব্দ ব্যবহার ভারী মজার। ওরা যে কোন কিছু বোঝাতে তার ঠিক বিপরীত শব্দ ব্যবহার করে। যেমন লক্ষ্মীছাড়া বোঝাতে ওরা বলে অলক্ষ্মীছাড়া। শিব কথার আসল মানে হল সূচি অর্থাৎ পবিত্র। অশিজি কথার মানে অশুচি। চাকমারা উল্টো শব্দ ব্যবহার করায় ওরা অশিজি বোঝাতে বদলে শিজি শব্দটি ব্যবহার করে।
চাকমা সমাজে ছোট ছেলেমেয়েদের ভর সন্ধ্যেবেলা বাইরে বেরোনোর ক্ষেত্রে এই শিজি অপদেবতার হাত থেকে বাঁচার জন্যে কয়েকটি নিয়ম প্রচলিত আছে। মায়েরা ছেলেমেয়েদের কপালে তেল-কালি দিয়ে টিপ পরিয়ে দেয়। চাকমাদের বিশ্বাস তেল কালি দিয়ে টিপ দিলেই নাকি শিজি আর ছেলে-মেয়েদের ওপর ভর করতে পারেনা। এছাড়া শিজির কোন নজর থেকে বাঁচতে চাকমারা তাদের ধান-জমিতে একটা লম্বা বাঁশ পুঁতে দেয়। বাঁশের মাথায় চুন দিয়ে আঁকি-বুকি আঁকা একটা হাঁড়ি বসিয়ে দেয়। দেখতে লাগে কাকতাড়ুয়ার মত। এগুলো আসলে শিজির প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য নিয়ম হিসেবে পালন করা হয়।
চাকমা সমাজে মনে করা হয় কোন শিশুর উপর শিজি ভর করলে আক্রান্ত বাচ্চা ভয় ভয় চাউনিতে তাকিয়ে থাকে।। শিশুটি একনাগাড়ে কেঁদে চলে। এমনকি জ্বরও চলে আসে। কাঁচা হলুদের টিপ তখনই শিশুটার কপালে দিতে হয়। তার পাশাপাশি মন্ত্রপুত সর্ষের পুটুলি গলায়, হাতে আর পায়ে বেঁধে দিতে হয়। তবেই নাকি রক্ষা পাওয়া যায়। তবে এই রক্ষা পাওয়াটাও সাময়িক। শিজির পুজো দিয়ে সন্তুষ্ট করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
একটা নির্দিষ্ট দিনক্ষণ দেখে পুজো করতে হয়। পুজোয় ওঝা দিয়ে শিজির সামনে কালো মুরগি বলি দিয়ে শিজি বা কালসুংকে করতে হয়। এভাবে পুজো করলেই নাকি শিজি খুশি হয়। গবেষকরা বলেন লোকজ
বিশ্বাসের বাইরে বেরিয়ে দেখলে এটা খেয়াল করা যায় যে জন্মের পর শিশুদের নানা ইনফেকশন হয়। বহু আগে চিকিৎসা বিদ্যার এতটা উন্নতি হয়নি। প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসার বিষয়ে সচেতনতার অভাব ছিল। সেখান থেকেই জন্ম হয়েছিল এই ধরনের অপদেবতার।