ঠাকুরবাড়ির ছেলেপুলেরা দ্বারকানাথের আমল থেকেই সাহেবিকেতায় ঝি-চাকরদের অধীনে-হাতে মানুষ। রবীন্দ্রনাথও তাই। মায়ের অন্দরমহল ছিল তাঁর কাছে এক দূরতর দ্বীপ। বাবা ছিলেন হিমালয় ও জমিদারি ফেরত সময়-সময়ের অতিথি। ফলে, তাঁদের সাথে মিলেমিশ হওয়ার সুযোগ দূরে থাক, শৈশবে মায়ের স্তন্যপান করার সুযোগটুকুও রবি পান নি। স্তন্যপান করেছেন ভাড়া করা কোন স্তনদায়িনীর। গণ্ডিবদ্ধ শৈশব। স্কুল আর বাড়ি--এই ছিল তাঁর পরিসর। তারপর এলো ১৮৭২ সাল। কলকাতায় ডেঙ্গু মহামারীর আকার নিল। তখন দ্বিজেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো ছেড়ে সবাইকে নিয়ে উঠলেন পানিহাটির বাগানবাড়িতে। রবীন্দ্রনাথের সেই প্রথম কলকাতার বাইরে যাওয়া। থাকা, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়, দু'মাস।
মাঘ মাসে রবীন্দ্রনাথের পৈতে হল। কানে ফুটো করে সোনার বীরবৌলি পরানো হল। মাথাটিও বিলকুল ন্যাড়া করে দেওয়া হল। সমবেত ইচ্ছেয় রবিকে স্বস্তি দিয়ে স্কুলের পাটও চুকিয়ে ফেলা হল। ডাক পড়ল তেতলার ঘরে। তেতলার ঘর, বাবার ঘর।
তেতলার ঘরটিতে পরে কাদম্বরী ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ থাকতেন। কিন্তু, যে সময়ের কথা বলছি, তখন তা ছিল একান্তই দেবেন্দ্রনাথের ঘর। তিনি না-থাকলে এ-ঘর তালাবন্ধ থাকত। রবীন্দ্রনাথ এ-ঘরে বাবার অনুপস্থিতিতে তালাবাঁচিয়ে কায়দা করে লুকিয়েচুরিয়ে অনেকবার ঢুকেছেন। চানঘরে চান করেছেন, অন্ধকার ঘরে বাবার ইজি চেয়ারে বসে একাকীত্ব উপভোগ করেছেন। কিন্তু, বাবার উপস্থিতিতে ঢুকছেন এই প্রথম। বাবা তাঁকে একা ডেকেছেন! আগে কোনদিন তো ডাকেননি! কেন ডেকেছেন, কী হয়েছে! মনে ভয়-সংকোচ মিলিয়ে এক অদ্ভুত দোলাচল। সেসব নিয়েই মাথা নীচু করে ধীর পায়ে রবি এসে দাঁড়ালেন বাবার কাছে। সৌম্য ঋষির মতো বাবা আরাম কেদারায় বসে। শান্ত চোখ। রবির দিকে একটু চুপ-চেয়ে বললেন, তিনি হিমালয়ে যাবেন। জানতে চাইলেন, রবি কি তাঁর সঙ্গে যেতে চান? এই প্রথম বাবা তাঁর মতামত চাইলেন। নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে দিলেন না। এই প্রথম ছেলেকে সিদ্ধান্ত নিতে দিলেন। রবি সিদ্ধান্ত নিলেন সঙ্গে সঙ্গে। তিনি তো প্রকৃতিতেই মুক্তি চান! তার জন্য হিমালয়ের চেয়ে আকর্ষণীয় আর কি-ই বা হতে পারে! তিনি রাজি। অনেক স্নেহ-বঞ্চনার পর রবি যেন এতদিনে এই প্রথম এমন আলাদা করে বাবার চোখে পড়ার সুযোগ পেলেন। দেবেন্দ্রনাথও যেন তাঁর ছোট ছেলেটির প্রতি এতদিনে অন্য রকম একটা টান অনুভব করলেন। বঞ্চনার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলেন। তার চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দিতে চাইলেন।
বাবার সঙ্গে রবি যখন হিমালয়ের পথে যাত্রা করলেন, তখন তাঁর মাথায় অল্প অল্প চুল। তাই মাথা ঢাকতে বাবা কিনে দিলেন জরির কাজ করা মখমলের গোল টুপি। প্রথমে গেলেন বোলপুর। দেবেন্দ্রনাথ এখানে রবিকে সময় দিতে শুরু করলেন, পড়াতে শুরু করলেন। দূরত্ব ঘুচতে লাগল, হল বন্ধুত্বের সূচনা। হয়তো এখান থেকেই মনে মনে এও ঠিক করে ফেললেন যে, শান্তিনিকেতন ও জমিদারির ভার তিনি একদা রবির হাতেই তুলে দেবেন। অন্যদিকে বাবার এই অভাবনীয় সস্নেহ-সান্নিধ্য ও প্রশ্রয় পেয়ে রবির কৈশোর বিকশিত হতে লাগল। তিনি এই সময় খোয়াইয়ের ধারে পাথরের স্তূপ বানিয়ে পাহাড় গড়ছেন, বাবাকে টেনে নিয়ে গিয়ে দেখাচ্ছেন। আর ছেলের এই ছেলেমানুষীকে ব্যক্তিত্বময় বাবাও উপহাস না-করে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, ছেলের আবদারে সেখানে বসে উপাসনা করছেন। ছেলেকে দিয়ে গাইয়ে নিচ্ছেন ব্রহ্মসঙ্গীত। 'বাবা দেবেন্দ্রনাথ'-কে এভাবেই প্রথম কাছে পেলেন রবি।
বাবার আভিজাত্য ও ব্যক্তিত্বকে তিনি প্রথম উপলব্ধি করলেন হিমালয়ের পথে, ট্রেনযাত্রার সময়। দেবেন্দ্রনাথ রবির জন্য কিনেছিলেন হাফ টিকিট। বারো বছরের কমবয়সীদের জন্য হাফ টিকিটই লাগত। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন এগারো। কিন্তু সেই বয়সেই রবীন্দ্রনাথ মাথায় বেড়েছিলেন অনেকখানি। দেখলে, একটু বেশি বয়স বলে মনে হত। তো, একটি স্টেশনে ট্রেন থামতেই টিটি এসে ধরল। দেবেন্দ্রনাথ রবির বয়স এগারো বললেও টিটির বিশ্বাস হল না। শুরু হল চাপান-উতোর। দেবেন্দ্রনাথ নিজের সততায় অটল, টিটি অবিশ্বাসে। তখন তো আর এখনকার মতো লোকে বয়সের প্রমাণপত্র নিয়ে ঘুরত না, সে-সুযোগও ছিল না। টিটির বিতণ্ডা দেবেন্দ্রনাথের মানে লাগল, তিনি বটুয়া খুলে পুরো ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। তিনি এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, টিটির ফেরৎ দেওয়া বাড়তি টাকা কটাও আর বটুয়াতে তুলে রাখলেন না, ছুঁড়ে দিলেন প্ল্যাটফর্মে। ঘটনাটা কিশোর রবির মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। 'সত্য' যে বাবার কাছে কতবড়, সেটা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
হিমালয়ে রবি পেলেন অবাধ বিচরণের স্বাধীনতা। প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর যোগটিকে এভাবেই বাবা পাকা হতে দিলেন। এই সময় বাবার সঙ্গে তাঁর পদ্যপাঠ এবং শব্দের অর্থ নিয়ে তর্কও হতে লাগল। বাবাও সেই তর্ককে প্রশ্রয় দিয়ে পুত্রের কল্পনা ও ভাবনাকে বিকশিত হওয়ার পরিসর দিতে চাইলেন। বন্ধুত্বও পাকা হতে লাগল। এখানে বাইরের প্রকৃতি অন্তরের সম্পদ হল, অন্তর-প্রকৃতিও ব্যাপ্ত হল।
হিমালয় থেকে রবি যখন ফিরলেন, তখন দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশেই অন্তঃপুরে রবি অবাধ প্রবেশের অধিকার পেলেন। মা ও বৌদিদের স্নেহের দ্বার অবারিত হল তাঁর কাছে। বঞ্চিত-বাল্য রবির কিশোরহৃদয়ে 'ঘর' আর 'বাহির' এক হওয়ার সুযোগ পেল; যা পরবর্তীকালে তাঁর 'কবিগুরু'-'গুরুদেব' হয়ে ওঠার একটি বিশিষ্ট দিক হয়ে উঠেছিল। এবং, এটা সম্ভব হয়েছিল, বন্ধু-বাবা দেবেন্দ্রনাথের জন্য।