ভারতীয় সংবিধানের প্রাণপুরুষ

তদানিন্তন বোম্বের এলফিনস্টন হাইস্কুল, শিক্ষক পড়াচ্ছেন ক্লাসে। একটি সমস্যা সমাধানের জন্য ক্লাসের পিছনের বেঞ্চে বসা একজন ছাত্রকে ডাকলেন শিক্ষক, ছাত্রটি উঠে আসছিলেন ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে।

মুহূর্তের মধ্যেই পুরো ক্লাসে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল। অন্যান্য ছাত্রেরা তাদের টিফিন বক্স রাখত ব্ল্যাকবোর্ডের পিছনে। ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে ঐ ছাত্রটি আসার আগেই সবাই তাড়াহুড়ো করে নিজেদের টিফিন বক্স সরাতে লাগল। কারণ ছাত্রটির ছোঁয়ায় যে সব খাবার অপবিত্র হয়ে যাবে।

ঘৃণা! ছাত্রটিকে ছোঁয়া যাবে না? কারণ ওই নিন্মবর্ণের পরিবারে জন্মেছে। মহর পরিবারে জন্ম নেওয়া একজন দলিত সে। তার কাছাকাছি আসলে কি আর খাবারের পবিত্রতা থাকবে? উচ্চবর্ণের মানুষদের তার সাথে মেলামেশা শোভা পায়? তাঁকে তো এক সময় জল পর্যন্ত পান করতে দিতেন না কেউ।

অবশ্য এসব নতুন কিছু না। সেই ছোটবেলা থেকে সয়ে আসছেন তিনি। বোম্বের এই স্কুলে তো তাও ক্লাসের বেঞ্চে বসার জায়গা মিলেছে। হোক না সেটা এককোণে। একদম শেষের সারির বেঞ্চে। গ্রামের স্কুলে তো তাও না!

ছেলেটির নাম বাবা সাহেব আম্বেদকর। ১৮৯১ সালে বর্তমান ভারতের মধ্যপ্রদেশের মোহ অঞ্চলে। রামজি মালোজি শাকপাল ও ভীমাবাইয়ের চতুর্দশ তথা সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন তিনি। পূর্বপুরুষদের প্রায় সবাই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। বাবা রামজি শাকপাল ছিলেন একজন সুবেদার মূলত এই পিতার ইচ্ছাতেই স্কুলের পাঠ শুরু হয় ভীম রাওয়ের। সেখানে দলিত হওয়ার কারণে, শৈশবেই তীব্র বিদ্ধেষের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে।

তাঁর পরিবার ছিল মারাঠী অধ্যুষিত বর্তমান কালের "মহারাষ্ট্র"-এর রত্নগিরি জেলার "আম্বোভাদ" শহরে। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিভুক্ত ছিল মহর জাতি, যারা অস্পৃশ্য জাতি হিসেবে পরিগণিত হত। প্রচণ্ড রকম আর্থ-সামাজিক বিভেদের সম্মুখীন হতে হত তাঁদের।  আম্বেদকর বিদ্যালয় গিয়ে ঠিক যে অস্পৃশ্যতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, তাঁকে আলাদা করে দেওয়া, এবং শিক্ষকদের দ্বারা অসহযোগীতা। শিক্ষাকক্ষের ভেতরে বসার অনুমতি ছিল না তাঁর, এমনকি তেষ্টার জলও জুটত না। কিন্তু আম্বেদকর বুঝেছিলেন শিক্ষাই পারে সব বদলে দিতে। রামজী শাকপাল ১৮৯৪ সালে অবসর নেন ও দুই বছর পরে তাঁরা সপরিবার সতর-এ চলে আসেন।আম্বেদকরের মা প্রয়াত হন।  মাসীর কাছেই বড় হতে থাকেন। শুধুমাত্র তিন ছেলে বালারাম, আনান্দ্রা ও ভীমরাও এবং দুই মেয়ে মঞ্জুলা ও তুলাসাদের মধ্যে আম্বেদকরই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং স্নাতক হন। ভীমরাও শাকপাল আম্বেদকরের কূলনামটি এসেছে তাঁর "রত্নগিরি" নিজগ্রাম আম্বভাদ থেকে। তাঁর ব্রাহ্মণ শিক্ষক মহাদেব আম্বেদকর, যিনি তাঁর আম্বেদকরের প্রতি অত্যন্ত স্নেহ পরায়ণ ছিলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তালিকায় তিনি নিজ গ্রাম আম্বোভাদকর থেকে পরিবর্তন করে আম্বেদকর রাখেন। সেই ছাত্রই ভারতের সংবিধানের রচয়িতা। ঐ প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে তিনি একে একে পিএইচডি, করেছে ডিলিট পেয়েছেন, লন্ডনে পড়তে গিয়েছেন। তিনি বুঝেছিলেন শিক্ষার দ্বারাই সব কিছুকে জয় করা সম্ভব।

১৫ই অগাস্ট ১৯৪৭ সাল ভারত স্বাধীনতার হল, দেশের প্রথম আইন মন্ত্রী হলেন ঐ ছেলেটিই। ২৯ই অগাস্ট, আম্বেদকরকে ভারতীয় সংবিধান খসড়া সমিতির সভাপতি করা হয়, আজ যা ভারতের মূল চালিকাশক্তি। আম্বেদকর পৃথিবীর দীর্ঘতম লিখিত সংবিধান রচনা করেন। ভারতের সংবিধান ভারতের প্রতিটি নাগরিককে, জনসাধারণকে অর্থ-সামাজিক-ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রধান করে। সমস্ত রকমের অসামঞ্জস্যতা, অস্পৃশ্যতার বিলোপ ঘটায়। সব ধরনের বৈষম্য বিধিবহির্ভূত করেন। অধিকার সুনিশ্চিত করে। ভারতের আইন প্রণেতারা আশা করেছিলেন এর মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূর হবে। হয়েছেও তাই। যার কান্ডারী আম্বেদকর। একা হাতেই তিনি মুক্ত করলেন সকলকে।

১৯৪৯ সালের ২৬ই নভেম্বর গণ-পরিষদ কর্তৃক সংবিধানটি গৃহীত হয়। মত পার্থক্যের কারণে আপোসহীন আম্বেদকর ১৯৫১ সালে পদত্যাগ করেন, আম্বেদকর স্বাধীনভাবে ১৯৫২-র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, কিন্তু হেরে যান। তাঁকে ঐ বছরই রাজ্যসভার সাংসদ পদে আসীন করা হয়, ১৯৫২ সালের মার্চ মাসে এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি সেই পদে আসীন ছিলেন।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...