প্রকৃতি। এক আশ্চর্য, অদ্ভুত মায়া-জগত। কখনও সে পরম মমতায় পৃথিবীকে সুন্দর করে। আবার কখনও তার বিধ্বংসী রূপ মানুষের জীবন তছনছ করে দেয়।
তেমনি এক গল্প বলব। সময়টা ১৮৯৬। আবহাওয়া দপ্তর থেকে এক বিশেষ সতর্কবার্তা জারি হল। ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে প্রবল ঝড় হওয়ার আশঙ্কা। কলকাতাবাসীদের ঘুম উড়ে গিয়েছে। নানা সর্তকতা অবলম্বন করছেন তাঁরা।
কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ঝড়ের দেখা নেই। হঠাৎ করেই ১ অক্টোবর আকাশে গভীর কালো মেঘের দেখা মিলল। এই বুঝি ঝড় আসবে।
ও মা! কোথায় কি! কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি হয়েই আকাশ পরিষ্কার।
ভারী অপদস্থ হল আবহাওয়া দপ্তর। তাঁরা বিভিন্ন খবরের কাগজে লিখে পাঠালেন, "কলিকাতায় ঝড় হইবার কথা ছিল, বোধহয় উপসাগরের কূলে প্রতিহত হইয়া ঝড় অন্য অভিমুখে চলিয়া গিয়াছে"।
ঝড় কোথায় গিয়েছে তা খুঁজে পাওয়ার জন্য সবদিকের লোক পাঠানো হল। কিন্তু তার কোন খোঁজ নেই। নানা খবরের কাগজে তখন বিজ্ঞান কাঠগড়ায়। অনেক খবরের কাগজ লিখেই ফেলল, "এতদিনে বুঝা গেল বিজ্ঞান সর্বৈব মিথ্যা"।
আবহাওয়া দপ্তরে ঝড় মাপার জন্য নানা যন্ত্রপাতি আনা হয়েছিল। সবই তবে মূল্যহীন। খবরের কাগজে শিরোনাম জুড়ে তখন নিরুদ্দেশ অনুসন্ধান চলছে। যে নিখোঁজ হয়েছে তার নাম "পলাতক তুফান''।
কোথায় গেল ঝড়?
উত্তর ছিল এক বিজ্ঞানীর কাছে। ওই বিজ্ঞানী তখন একটি জাহাজে করে সমুদ্র যাত্রা করেছিলেন। ২৮ সেপ্টেম্বর হঠাৎ-ই তার জাহাজে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সমুদ্রের ঢেউ ও জলরাশির আন্দোলন। প্রচন্ড ঝড়ের পূর্বাভাস।
বিজ্ঞানীর কাছে ছিল তাঁর মাথার তেল। হঠাৎ করে মনে পড়ল, তাঁর বর্তমান গবেষণার বিষয় তেল কীভাবে চঞ্চল সমুদ্রের জলকে মসৃণ ও শান্ত করে। তাঁর ওই তেলের নাম ছিল "কুন্তল-কেশরী"। নিজের গবেষণায় পাওয়া তথ্যের উপর বিচার করে তিনি তাঁর এক শিশি মাথার তেল ঢেলে দিলেন জলে। শান্ত হল সমুদ্র। এভাবেই ঝড়কে শান্ত করেছিলেন এক বিজ্ঞানী।
এমন অদ্ভুত ব্যাপার আবার হয় নাকি!
আসলে সেই বিজ্ঞানী ছিলেন ‘কল্পবিজ্ঞানী’। নিজেকে ‘কল্পবিজ্ঞানী’ হিসেবে কল্পনা করে নিয়েছিলেন তিনি। অনুভূতিপ্রবণ, এক অসম্ভব মেধাবী বিজ্ঞানী।
উপরের গল্পটি জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনী। নাম ''পলাতক তুফান''। প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯৬ সালে। বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের জনক বলা হয় জগদীশচন্দ্র বসুকে।
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু অনুভূতিপ্রবণ মানুষ ছিলেন। ঝড়, বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভারী কষ্ট দিত তাঁকে।
তাই ভাবতেন, প্রকৃতির এই কঠিন রূপকে কি কোনভাবে জয় করা যায় না? তাই তাঁর কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীগুলির প্রধান চরিত্র হয়ে উঠত প্রকৃতি ও দুর্যোগ।
এই পৃথিবীর সমস্ত সজীব বস্তুকে আপন ভাবতেন তিনি। তাই তো ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে গাছেদের নানা প্রতিক্রিয়া আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। সেই যন্ত্রটিও তাঁরই আবিষ্কার।
অনুভূতি আর কল্পবিজ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু।
১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকার বিক্রমপুরে জন্ম তাঁর। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের আকর্ষণ ছিল চুম্বকের মত। শিক্ষা ও গবেষণার জন্য পাড়ি দিয়েছিলেন বিদেশে।
কল্পবিজ্ঞান সংক্রান্ত তাঁর সমস্ত প্রবন্ধ একত্রিত করে ছাপা হয়েছিল ''অব্যক্ত'' নামের বইটিতে।
কাহিনীগুলো নিজস্ব ভঙ্গিতে স্বতন্ত্র। কোনও অতিমানব বা সুপার-হিরো ছিল না তাঁর কল্পবিজ্ঞানের গল্পে। শুধু থাকতেন এক কল্পবিজ্ঞানী। সেই ভূমিকায় আসলে তিনি নিজেই।
খুব সহজ ও সাধারণ গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের সাহায্যে প্রকৃতির অসাধারণ সমস্যার সমাধান করত তাঁর রচিত কাহিনী।
তাঁর কাহিনীগুলিতে মানুষের স্বাভাবিক বোধ, চিন্তা, আবেগ ও সূক্ষ্মতার আলাদা গুরুত্ব ছিল।
এই কল্পবিজ্ঞানীর পরিবার ছিল। তিনি আপনজনদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কখনও সে স্নেহশীল বাবা আবার কখনও কর্তব্যপরায়ণ বিজ্ঞানী। জীবনের খুব সাধারণ সমস্যাকে ঘিরেই কল্পবিজ্ঞানের গল্প আবর্তিত হত জগদীশচন্দ্র বসুর কলমে।
মানুষের প্রতিদিনের সমস্যা, ভালবাসা, আক্ষেপ যে বিজ্ঞানের কোন একটা কল্পনার জগতে স্থান পেতে পারে জগদীশচন্দ্র বসুই তাঁর সাহিত্য-সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের দেখেছিলেন।
তাঁর কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীগুলি বেশিরভাগই ইংরেজিতে লেখা। পরে তা বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন অনুবাদক বোধিসত্ত্ব চট্টোপাধ্যায়।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নিঃস্বার্থভাবে বিজ্ঞানকে ভালোবেসেছেন এই বিজ্ঞানী। তাই তাঁর কল্পনার কাহিনীতেও ভালবাসারা বরাবর স্বতন্ত্র জায়গা পেয়েছে।