এ দেশে যখন প্রথম কেবল নেটওয়ার্ক পরিষেবা আসে, সে সময় দু’-একটি আন্তর্জাতিক চ্যানেলের প্রকৃতি-নির্ভর অনুষ্ঠানে ছোট থেকে বড় সকলেরই বিস্ময়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বিভিন্ন ফরেস্ট রিজারভেশন-এ কিংবা চিড়িয়াখানায় যে বাঘা বাঘা কুমীরদের দূর থেকে চাক্ষুষ করে আমরা সন্তুষ্ট হই, সেই পেল্লায় কুমীরদের সঙ্গেই নাকি তিনি দিনরাত সময় কাটাচ্ছেন, হাসছেন-খেলছেন। দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন দুর্ভেদ্য জঙ্গল, গভীর সমুদ্র। প্রকৃতির সঙ্গে বিশেষ ভাব থাকা স্বত্বেও আজকের তারিখে অর্থাৎ ৪ সেপ্টেম্বর একটি আন্তর্জাতিক টি.ভি শো’র শুটিং চলাকালীনই স্টিংরে মাছের হানায় অকস্মাৎ প্রাণ হারিয়েছিলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ান কনজারভেশনিস্ট স্টিভ আরউইনের কাহিনি এখনও সকলের হৃদয়ে গাঁথা।
স্টিভের বয়স যখন ৯-এর কোটায়, তখন থেকেই কুমীরদের সঙ্গে তাঁর অবাধ বন্ধুত্ব। বন্যপ্রাণের প্রতি স্টিভ আরউইনের এই অভিনব ও তীব্র ভালবাসার নেপথ্যে রয়েছেন তাঁর বাবা-মা বব এবং লিন আরউইন। ছেলে স্টিভের ছ’বছরের জন্মদিনে ১১ ফুট লম্বা একটি অজগর উপহার দিয়েছিলেন তাঁরা। তখন থেকেই প্রকৃতির অন্যান্য সদস্যদের প্রতি ভালোবাসা জন্মায় ছোট্ট স্টিভের মনে। পরে আরউইন পরিবার অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে চলে যায়। সেখানে তাঁরা একটি সরীসৃপ পার্ক উদ্বোধন করেন, যা বিয়ারওয়াহ রেপটাইল পার্ক নামে পরিচিত। কুইন্সল্যান্ডের ইস্ট কোস্ট কুমির ব্যবস্থাপনা প্রোগ্রামের (Queensland's East Coast Crocodile Management Program) স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন স্টিভ। পৃথিবীর সবথেকে বড় জীবন্ত সরীসৃপ অর্থাৎ নোনাজলের বিপন্ন কুমীরদের (endangered saltwater crocodiles) ধরা এবং সেই কুমীরদের সঠিক জায়গায় স্থানান্তরিত করতে সহায়তা করতেন স্টিভ। স্টিভ তাঁদের পারিবারিক রেপটাইল পার্কটিও পরিচালনা করতে শুরু করেন, পরবর্তীকালে যার নামকরণ করা হয়েছিল কুইন্সল্যান্ড রেপটাইল অ্যান্ড ফনা পার্ক (Queensland Reptile and Fauna Park) এবং আরও পরে অস্ট্রেলিয়া চিড়িয়াখানা হয়ে ওঠে এটি।
স্টিভের প্রেমের শুরুটাও চিড়িয়াখানাতেই। তাঁর স্ত্রী টেরি যখন চিড়িয়াখানা ঘুরতে আসতেন তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় স্টিভের। এমনকি নিজেদের মধুচন্দ্রিমাও স্টিভ এবং টেরি কাটিয়েছিলেন কুমীরদের জড়িয়ে, কুমীরদের ঘিরেই।
স্টিভ আরউইনের বিখ্যাত টেলিভিশন শো, ‘ক্রোকোডাইল হান্টার’-এর প্রথম পর্বের বিষয়ই ছিল স্টিভ ও তাঁর স্ত্রী টেরির হানিমুনে তোলা কুমিরদের একটি ভিডিও ফুটেজ। স্টিভ আরউইন এবং টেরি আরউইন একসঙ্গেই এই অনুষ্ঠান হোস্ট করতেন। পরে অবশ্য তাঁদের দুই সন্তান রবার্ট এবং বিন্দিও নিয়মিত এই শোয়ের অংশ হয়ে উঠেছিলেন। স্টিভের ক্রোকোডাইল হান্টার শো ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সারা বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশের প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ এই শো দেখতেন। এখনও তাঁর ‘লেগেসি’ বহন করে চলেছে তাঁর পরিবার।
২০০১ সালে স্টিভ আরউইন শতাব্দী পদক সম্মান পান। ২০০৪ সালে স্টিভ মনোনীত হন অস্ট্রেলিয়ান অফ দ্য ইয়ার-এর জন্য। হলিউড ওয়াক অফ ফেমের মরণোত্তর সম্মানও পেয়েছেন তিনি। ২০০৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর, গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে ডুব-সাঁতার দেওয়ার সময় ৪২ বছর বয়সে স্টিংরে-র হুলের আঘাতে প্রকৃতির মধ্যেই মৃত্যু কোলে ঢলে পড়েন তিনি।