বাংলার মেলা: সিংটি ভাই খাঁ পীরের মেলা

"আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর
সেথা এক পড়শি বসত করে"...

আজকের মেলা পর্ব লিখতে গিয়ে লালন ফকিরের লেখা এই গানটি মনে পড়ে গেল। কেন জানেন পাঠক বন্ধুরা? কারণ আমার নিজের শহর অর্থাৎ কলকাতার ঠিক পাশের জেলা হচ্ছে হাওড়া। আমাদের যাকে বলে "নেক্সট ডোর নেইবার"... অথচ আমরা ক'জন খবর রাখি যে একেবারে ঘরের পাশের জেলাটায় একটা মেলা বসে যে মেলার বয়স সাতশো বছর.... ঠিকই পড়েছেন বন্ধু, সাতশো বছর।

আর এই মেলার একটা বিশেষ নাম আছে...কাঁকড়া এবং আলুরদমের মেলা। এই মেলায় কাঁকড়া বিক্রি হয়... ছোট কুচো আকৃতির থেকে তিনশো বা চারশো গ্ৰাম ওজনের এক একটা কাঁকড়া। কি মজার কথা না? বিক্রেতারা কেউ আসেন ক্যানিং থেকে,কেউ হাসনাবাদ, কেউ সুন্দরবন আবার কেউ বা কাকদ্বীপ থেকে।

সাথে নিয়ে আসেন বিভিন্ন ধরণের বিভিন্ন সাইজের কাঁকড়া। কাঁকড়ার পাশাপাশি ঢেলে বিক্রি হয় শুঁটকি মাছ। মেলার একটা দিকে শুধুই এই কাঁকড়া বিক্রি চলে। আর একটা বড় অংশ জুড়ে বিক্রি হয় আলুর দম।

এবার এই কাঁকড়া-আলুর দম মেলার ব্যাপারে কিছু গল্প বলি আসুন। অল্প অল্প গল্প আর বেশি বেশি সত্যি। হাওড়া জেলার উদয়নারায়ণপুর ব্লকের সিংটী গ্রামের সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এই মেলার আসল নাম "ভাই খাঁ পীরের মেলা"। প্রতি বছর পয়লা মাঘ সিংটী গ্ৰামের খাঁ পাড়ায় বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে ৫০০ বছরেরও প্রাচীন এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

এই ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলির পিছনে একটা না একটা কিংবদন্তী থাকেই। এই মেলাও তার ব্যতিক্রম নয়। কিছু সত্যি আর কিছুটা কল্পনা মিশ্রিত যে কাহিনী প্রচলিত আছে তা হল সাতশো বছর আগে আরব দেশ থেকে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরের সিংটি গ্ৰামে আসেন এক মুসলমান পীর।

তিনি এই গ্ৰামের একধারে বাসা বেঁধে বাস করতে শুরু করেন। তাঁর আসল নাম কেউই জানত না। কিন্তু ছোট ছোট ছেলেদের তিনি ভারি স্নেহ করতেন এবং ছোট রাখাল বালকরা তাঁকে "ভাই খাঁ" বলে ডাকত। সেই থেকে গ্ৰামবাসীরা সেই নামেই তাঁকে ডাকতে শুরু করল। সেই ভাই খাঁ নাকি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তাই মানুষ জন তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করত এবং ভাই খাঁ পীর নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।

এই ভাই খাঁ পীর পরলোকগমন করেছিলেন তিরিশে পৌষ এবং তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল তার পরের দিন। সেদিন নাকি লক্ষাধিক মানুষ এসেছিলেন তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে। মাঘ মাসের প্রথম দিন ছিল সেই দিনটি। অত মানুষ আসায় সেখানে নাকি একটা মেলা বসে গিয়েছিল। তখন থেকেই প্রত্যেক বছর এই ভাই খাঁ পীরের সমাধি দিবসে তাঁর নামেই এই মেলা বসে।

অন্যান্য মেলার সঙ্গে এই মেলার পার্থক্য হলো অন্য মেলার মতো এই মেলা তিন চার দিন চলে না। এই মেলার আয়ু একদিনই...পয়লা মাঘ। এই মেলার বিশেষত্ব প্রথমেই লিখেছি। কাঁকড়া বিক্রি হয় কেন সেটা বিশেষ কেউই জানেন না কিন্তু আলুর দম বিক্রির কারণ এই অঞ্চল আলু চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। অপরিমিত আলুর ফলন হয়।

সেই আলু বিক্রির একটা পদ্ধতিও হলো আলুর দম বানিয়ে বিক্রি করা। এখনো এই মেলায় লক্ষাধিক মানুষ আসেন। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে প্রচুরসংখ্যক মানুষ আসেন ভাই খাঁ পীরকে শ্রদ্ধা জানাতে। ভাই খাঁ পীরের মাজারে তারা তাদের মনস্কামনা পূরণের জন্য প্রার্থনা জানান। ওহ্ লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম... এই মেলায় প্রচুর কুল এবং শাকালুও বিক্রি হয়। ক্রেতা বিক্রেতা ভক্ত দর্শকের ভিড়ে জমজমাট হয়ে ওঠে মেলা।

দুপুরের পর থেকেই লোক আসতে শুরু করে। এমনি মেলায় যা যা পাওয়া যায় সেই খেলনা, জিলিপি, তেলেভাজা, বাসনপত্র সেসবের দোকানেও দিব্যি বিকিকিনি চলে। তারপর মানুষেরা পেট ভরে আলুর দম মুড়ি খেয়ে থলি ভরে কাঁকড়া কিনে নিয়ে তৃপ্ত মনে বাড়িতে ফিরে যায়। অপেক্ষা শুরু হয় পরের বছরের মেলার জন্য।

পাঠক বন্ধুগণ, আমার মেলাও আজ এখানেই ভাঙল? আবার পরের সপ্তাহে আপনাদের নতুন মেলায় বেড়াতে নিয়ে যাব কেমন?

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...