বাংলার মেলা কথা কেঁদুলির জয়দেব মেলা

শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলা দেখা তো আমাদের শেষ হল। তো আমরা কি ফিরে আসব? নাকি বীরভূম জেলাতেই কাছে পিঠে ঘুরে খোঁজ খবর করব আর কোন মেলায় বেড়াতে যাওয়া যেতে পারে?
আরে, এই তো বীরভূমের আরেকটা বিখ্যাত মেলা কেঁদুলির জয়দেব মেলা!

তাহলে আর দেরি না করে চলুন পাঠক বন্ধুরা, এই শীতের আমেজ নিয়ে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে মনের পাখনা মেলে উড়তে উড়তে চলে যাই বর্ধমান বীরভূম সীমান্তে অজয় নদের তীরে অবস্থিত কেঁদুলীতে। সেখানকার বাউলরা আমার মন-বাউলকে ডাকছে যে। এই তো, এসে পড়েছি কেন্দুবিল্ব বা কেঁদুলি গ্রামে।

আমরা সবাই তো "গীতগোবিন্দ" কাব্যের নাম জানি তাই না? আর এই গীতগোবিন্দ কাব্যের রচয়িতা কে সেটা মনে আছে? বলুন দেখি? ঠিক... একেবারে ঠিক বলেছেন। কবি জয়দেব গোস্বামী। বাংলা গীতিকবিতার প্রথম স্রষ্টা হলেন রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেব। দ্বাদশ শতকে রচিত তাঁর 'গীতগোবিন্দ' সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই জয়দেবের জন্মস্থান ছিল কেন্দুবিল্ব । এই কেন্দুবিল্বই অপভ্রংশ হয়ে কেঁদুলি বা কেন্দুলি হয়। আর তাঁরই স্মৃতিবিজড়িত কেঁদুলির জয়দেব মেলা। কিংবদন্তী রয়েছে যে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ নিজের হাতে কলম তুলে নিয়ে গীতগোবিন্দ কাব্যে পদ সংযোজন করেছিলেন।

জয়দেব-কেঁদুলির মেলা বহু প্রাচীন। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে অজয়তীরে কেন্দুবিল্বে জয়দেব গোস্বামীর মেলার কথা রয়েছে। এই মেলা নিয়ে নানা কিংবদন্তী রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত এইই যে--- সংস্কৃত সাহিত্য এবং সঙ্গীত শাস্ত্রে অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন জয়দেব গোস্বামী। তিনি 'গীতগোবিন্দ’ রচনা করেছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীতে ...১১৫৯ সালে।

Jaydeb-Mela1

প্রত্যেক পৌষমাসের শেষ দিন অর্থাৎ মকর সংক্রান্তির দিন কবি জয়দেব ভোরবেলা গঙ্গাস্নানে কাটোয়ায় যেতেন। এক বার অসুস্থতার কারণে তিনি গঙ্গাস্নানে যেতে পারেন নি। এর জন্য মনের মধ্যে তাঁর ভারি অশান্তি অনুভূত হয়। মকর সংক্রান্তির আগের রাতে কবি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন। তিনি দেখলেন মকরবাহিনী গঙ্গা হেসে তাঁকে বলছেন—‘দুঃখ করো না। তুমি যেতে না পারলে আমিই আসব অজয়ের স্রোত বেয়ে কদমখণ্ডীর ঘাটে। তোমার স্পর্শ পেয়ে আমি ধন্য হব"......

ঘুম ভেঙে গেল কবির। বিস্মিত তিনি। ভোরের অন্ধকারে অজয়ের কদমখণ্ডীর ঘাটে গিয়ে উপস্থিত হলেন কবি। দেখলেন অজয়ের জলধারা থেকে দুটি সোনার চুড়ি পরা সোনার বরণ হাত বেরিয়ে উপর দিকে উঠে আছে। কবি বুঝতে পারলেন যে মা গঙ্গা স্বপ্নে কবিবরকে জানিয়েছিলেন তাঁর আগমন বার্তা। মা-গঙ্গার দেখা পেয়ে উল্লসিত অভিভূত কবি জয়দেব। আনন্দে আপ্লুত হয়ে অনেক সাধু-সন্ন্যাসীদের নিমন্ত্রণ জানিয়ে তিনি এক মহোৎসবের আয়োজন করে ফেললেন।

কথিত আছেন তখন থেকেই ওই দিনটি স্মরণে প্রত্যেক বছর কেঁদুলিতে বহু বৈষ্ণবের সমাগম ঘটে এবং মহোৎসব হয়। দ্বাদশ শতাব্দীর কোনও এক পৌষ সংক্রান্তির দিনই জয়দেবের তিরোধান ঘটে। এর চারশো বছরেরও বেশি পরে বর্ধমান রাজবাড়ির তরফ থেকে কেঁদুলিতে জয়দেবের জন্মভিটের উপরে রাধাবিনোদ অর্থাৎ রাধা কৃষ্ণের মন্দির তৈরি করা হয়।

বর্ধমানের রাজা ত্রিলোকচাঁদ বাহাদুর ১৬৯২ সালের পৌষ সংক্রান্তির দিনই নাকি ওই মন্দিরে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন এবং মন্দির উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষে এক বিশাল উৎসবের আয়োজন করেন। মনে করা হয় জয়দেবের স্মৃতিরক্ষার্থে আয়োজিত সেই উৎসবই এক দিন জয়দেব মেলা নামে পরিচিত হয়। এই মেলার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও। ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলির অন্যতম এই জয়দেব মেলা। সারা রাজ্য থেকে বাউল ফকিররা জড়ো হন এখানে। চারদিন ধরে চলা এই মেলায় দেশ-বিদেশের বহু মানুষ বাউল ফকির গানের টানে আসেন।

এবার আসি তাহলে? পরের সপ্তাহে আবার নতুন কোনও মেলায় বেড়াতে যাব আমরা সবাই কেমন?

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...