তাহলে সবাই মেলায় ডানা মেলার জন্য প্রস্তুত তো পাঠক বন্ধুগন? চলুন, মনের ডানার পালকে শীতের নরম রোদ মেখে ওড়া শুরু করি আমরা। আজ প্রথম যে মেলায় আপনাদের নিয়ে যাব সেই মেলাটির বয়স এই বঙ্গেই সত্তর বছর। ১৯৫০-এর আগে এই মেলাটি বসতো বাংলাদেশের ঢাকা জেলার রোহিতপুর গ্ৰামে। কিন্তু বর্তমানে এই মেলাটি বসে দক্ষিণ কলকাতার বিজয়গড় শ্রীকলোনী এলাকার যুবসংঘ ময়দানে। মেলাটির নাম "বারো ভূতের মেলা"।
পাঠক নিশ্চয়ই প্রথমেই একটু অবাক হতে শুরু করেছেন; কেউ কেউ হয়তো একটু একটু ভয়ও পেয়ে গেছেন। ভাবতে শুরু করেছেন যে এই লেখিকা বুঝি আপনাদের কোনো ভৌতিক কারবারের মধ্যে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করবে। আরে না না পাঠক বন্ধুরা, ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ভূত প্রেত কিছু নয়, এই বারো ভূত হচ্ছেন বিষ্ণু বা নারায়ণের দ্বাদশ রূপ বা অবতার।
এবার বলি এই মেলা নিয়েই কেন আমাদের মেলা যাত্রা শুরু করলাম। মেলা কথা বলতে হয় তাহলে বন্ধুগণ। ছোট করে বলি? আসলে এই শ্রীকলোনী নেতাজিনগর এলাকাতেই এই নিবন্ধকারের জন্ম, ছোট থেকে বড় হওয়া, বড় থেকে প্রায় বুড়ো হওয়ার দিকে এগোনো। এই বারো ভূতের মেলায় যে কোন শৈশবে ঠাকুরমার হাত ধরে যাওয়া শুরু হয়েছিল তা আজ আর আমার মনেও নেই। কিন্তু মেলা বললেই "রথের মেলা" বা "পৌষ মেলার" পরিবর্তে আমার প্রথমেই বারো ভূতের মেলার কথাই মনে পড়ে।
এই গেল প্রাক মেলা কথন। এবার একটু মূল মেলায় যাই চলুন। বারো ভূতের মেলা শুরু হয় মকর সংক্রান্তির আগের দিন। আটদিন ধরে চলে এই মেলা। সম্ভবতঃ দক্ষিণ কলকাতার সবথেকে বড় মেলা এটি। বারো ভূতের মেলা এই শ্রীকলোনী যুবসংঘ ময়দানে বসছে গত সত্তর বছর ধরে। ১৯৪৭ -এ দেশভাগের পর হাজার হাজার মানুষ পূর্ব বাংলা থেকে কলকাতায় চলে আসেন এবং এই বিজয়গড়, লায়েলকা, শ্রীকলোনী এলাকায় বসত গড়ে তোলেন। এবং তাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে এই বারো ভূতের মেলা এই কলকাতায় নিয়ে আসেন। এই বিজয়গড় শ্রীকলোনীতেই রয়েছে নারায়ণের দ্বাদশ অবতারের মূর্তি সহ সুন্দর একটি মন্দির। মকর সংক্রান্তির দিন সেখানে পুজো দিয়ে মেলা শুরু হয়। গঙ্গাসাগর ফেরত বেশ কয়েকজন সাধুও এসে থেকে যান এখানে এই মেলার ক'দিন।
এবার একটা সুন্দর এবং মজার তথ্য জানানো যাক। মকর সংক্রান্তির আগের দিন ঐ বারো ভূত মন্দিরেই হয় বুড়িমার পুজো। এই বুড়ি মা হলেন বনদুর্গা। বনের দেবী। এবং এই দেবী আরাধনার মূল নৈবেদ্য হলো হাঁসের ডিম। এই বনদুর্গার পুজো আগে হতো বাংলাদেশের রোহিতপুর গ্ৰামে। ঘন জঙ্গল ঘেরা গ্ৰামে হিংস্র পশুদের আক্রমণ লেগেই থাকত। মানুষজন এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেবী বনদুর্গার আরাধনা করতো। প্রচলিত কিংবদন্তী এইরকম যে দেবী একদিন এক বৃদ্ধার ছদ্মবেশে এক দরিদ্র ভক্তের বাড়িতে গিয়েছিলেন কিন্তু সেই দরিদ্র মানুষটির বাড়িতে তখন হাঁসের ডিম এবং চাল ছাড়া আর কিছু ছিল না। সেই দরিদ্র ভক্ত ভাত আর ডিম রান্না করেই সেই বুড়িমাকে খেতে দিয়েছিলেন। দেবী সেই ভোগ গ্ৰহণ করেই অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। সেই থেকেই হাঁসের ডিম দিয়ে দেবী বনদুর্গার বা বুড়িমার পুজো হয়ে আসছে। দেশভাগের পর ছিন্নমূল মানুষগুলো এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন যেমন করলেন তেমনি গাঁয়ের দেবী বনদুর্গার পুজোও চালু করলেন। সেই ১৯৫১ সাল থেকে বারো ভূতের পাশাপাশি বুড়িমার পুজোও হয়ে আসছে।
এখনো হাজার হাজার ভক্ত এই বারো ভূতের মেলায় আসেন এবং হাঁসের ডিম দিয়ে বুড়িমার আরাধনা করেন।
মেলা উপলক্ষ্যে বারো ভূত মন্দিরটি এবং মন্দির সংলগ্ন রাস্তাগুলিও আলোর মালায় সেজে ওঠে। দোকানদাররা নানান রকমের জিনিসপত্রের দোকান সাজিয়ে বসেন। কী না পাওয়া যায় সেখানে! ঘরকন্নার সমস্ত জিনিস, আসবাবপত্র, ছোটদের জন্য খেলনা, মাটির পুতুল, গয়না, কাঁচের চুড়ি, বই, মেয়েদের সাজগোজের জিনিস, বাসনপত্র, জামাকাপড়, বিছানার চাদর এবং খাবার... কতো রকমের যে খাবারের দোকান বসে আর সে যে কী অপূর্ব ধুলোবালি মাখা স্বাদ তাদের... কী বলব বন্ধুরা! এছাড়াও পুতুলনাচ, কথা-বলা পুতুল, বিভিন্ন জয়-রাইড এসবের আকর্ষণ এড়ানো খুবই কঠিন। একদিন গিয়ে আপনার মন ভরবে না। মনে হবে "আরো কয়েকবার যাই"..
কিন্তু এইবছর এই ভয়ঙ্কর অতিমারীর কারণে মেলা স্থগিত রাখা হয়েছে। তাতে কী? ঝড় তো একদিন থামবেই তাই না? পরের বছর নিশ্চয়ই বারোভূতের মেলা বসবে। তখন, হে পাঠকবৃন্দ, আপনাদের মনে মনে বেড়াতে হবে না, স্বচক্ষে দেখতে পারবেন এবং স্ব-পদে ঘুরতে আসতে পারবেন এই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বারো ভূতের মেলায়।
আজকের মেলা পর্ব তাহলে এখানে শেষ করি? পড়ে কেমন লাগলো জানাবেন। আবার দেখা হবে পরের পর্বে... নতুন মেলায় বেড়াতে যাব আমরা সবাই...