"আমি চিনি গো চিনি তোমারে
ওগো বিদেশিনী"...
কবিগুরু কী দেখে বা কাকে দেখে এই গান লিখেছিলেন আপনারা জানেন কি? হ্যাঁ পাঠক আমি জানি যে আপনাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো রবীন্দ্র-গবেষক আছেন। তাঁরা হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর এক্ষুনি দিয়ে দেবেন। কিন্তু সেসব তো আপনাদের পুস্তক প্রাপ্ত জ্ঞান বা তথ্য। এর উত্তর এই আর্টিকেল লিখিয়েরই একমাত্র ঠিকঠাক জানা আছে।
উত্তরটি হলো "চিনি" যাকে শুদ্ধ ভাষায় "শর্করা" বলা হয় সেই "চিনি" খেয়ে মুগ্ধ হয়ে কবিগুরু এই গান রচনা করেছিলেন। না না পাঠক বন্ধুরা, এসব অদ্ভুতুড়ে তথ্য বা আলোচনায় ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই। বিশুদ্ধ মজা ছাড়া এসব কথা বলার বা লেখার আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।
দেখুন, কোথায় মেলা নিয়ে গুরুগম্ভীর আর্টিকেল লিখব তা নয় ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া শুরু করে দিয়েছি। কিন্তু সত্যি সত্যিই আজকের মেলার সঙ্গে চিনি এবং চীন – এই দুইয়েরই সম্পর্ক রয়েছে। আজ আপনাদের নিয়ে যাব দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অছিপুরের চীনা মেলায়।
হিন্দি-চিনি কতটা "ভাই ভাই" আমাদের জানা নেই কিন্তু বাংলা-চীন এই দুইয়ের সম্পর্ক কিন্তু প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের। চলুন যাওয়া যাক কলকাতার খুব কাছাকাছি, দক্ষিণ কলকাতার তারাতলা থেকে মাত্র তিরিশ কিলোমিটার দূরে বজবজ অছিপুরে। ১৭৭৮ খ্রীষ্টাব্দ বা তার আশেপাশের সময়ে এখানেই প্রথম চীনা বসতি স্থাপন করেছিলেন বাংলার প্রথম চীনা ব্যবসায়ী টং অ্যাচিউ বা অ্যাছিউ।
১৭৭৮ সালের এক দলিল বা নথি থেকে জানা যায় যে ঐ সময় গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এর কাছে চিনির কারখানা খোলার জন্য জমি চেয়েছিলেন অ্যাছিউ। হেস্টিংস মাত্র পঁয়তাল্লিশ টাকা বার্ষিক ভাড়ায় ৬৫০ বিঘা জমি দিয়ে দিয়েছিলেন চিনির কারখানার জন্য। সেই জমিতে বড় একটা চিনি কল খুললেন আছিউ বা অ্যাচিউ। স্থানীয় মানুষের কাছে তিনি ততদিনে আছি সাহেব নামে পরিচিত হয়ে গেছেন।
তাঁর নামেই পরবর্তী সময়ে সেই জায়গাটির নাম আছিপুর বা অছিপুর হয়ে যায়। এই চিনিকলে কাজ করার জন্য চীন দেশ থেকে অনেক চীনা শ্রমিককে নিয়ে এলেন অ্যাচিউ টং। সেই সময় থেকেই বজবজ এবং কলকাতায় বেশ বড়সড় একটা চীনা জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে।
কিন্তু মাত্র তিন বছরের মধ্যে অ্যাচিউ টঙের মৃত্যু হয়। তারপর সেই চিনি কল বন্ধ হয়ে গেলেও সেখানে থেকে গিয়েছে অ্যাচিউ এর অশ্বখুরাকৃতি সমাধিটি এবং সুন্দর একটি চীনা মন্দির। সেই মন্দিরের ভিতরে স্থাপিত রয়েছেন চীনা দেবদেবী খুদা-খুদি যাদের চীনা মানুষজন পৃথিবীর দেবদেবী বলে মনে করেন। কথিত আছে টং অ্যাচিউ নিজের হাতে চীন থেকে এই দেবদেবীর মূর্তি নিয়ে এসে হুগলি নদীর তীরে এই মন্দির তৈরি করে সেখানে খুদা-খুদিকে স্থাপন করেন।
তাই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম চায়না টাউন বলতে কিন্তু অছিপুরকেই বোঝায়। এবং এই অ্যাচিউ টংকে চীনারা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে বলে থাকেন "তাই পাক কুং" অর্থাৎ "সর্বজ্যেষ্ঠ পিতামহ"..।
এই সুন্দর মন্দির চীনা মানুষদের কাছে অতি পবিত্র স্থান। চীনা নববর্ষের প্রথম দিনটি শুরু হয় ২১ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নতুন চাঁদ দেখতে পাওয়ার মধ্য দিয়ে। প্রত্যেক বছর চীনা নববর্ষ উপলক্ষে এই অছিপুরে মেলা বসে। মন্দিরে দেবদেবীর আরাধনা করা হয়।
এই পুজোর প্রসাদের নতুনত্ব হলো দেবদেবীর ভোগ বা প্রসাদ হিসেবে নানারকম ফলের পাশাপাশি মদ এবং চিকেনও দেওয়া হয়। এই মন্দির সুন্দর আলো দিয়ে সাজানো হয়। এই মেলা দেখতে কলকাতা থেকে বা অন্যান্য অঞ্চল থেকে বাংলায় বসবাসকারী বহু চীনা মানুষদের যেমন ভিড় হয় তেমনই অন্য ধর্মের মানুষরাও দল বেঁধে আসেন এই মেলা এবং মন্দির দেখতে। সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিকে এই মেলা বসে।
তাহলে, চীনে মেলায় বেড়ানোটা মন্দ হল না বলুন? আর বুঝতে পারলেন তো চিনি-বাংলা-চীন কীভাবে এই বাংলায় এক দেহে লীন হয়ে গেছে!
পরের সপ্তাহে আবার যাব নতুন কোনো মেলায়। ততক্ষণ রহু ধৈর্য্যং বন্ধু।