ছেলেটা শালপাতায় মোড়া খাবারের টুকরোগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। কারোর ফেলে দেওয়া খাবার শালপাতার সাজিয়ে অন্য কেউ দিয়েছে ওকে। ও বুঝতে পারছে। তবুও এই অসম্মানটুকু এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই ওর কাছে। খাবারটুকুর জন্য ওর পরিবারের আরো চার পাঁচ জন অপেক্ষা করে রয়েছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ওর বয়সী বা ওর থেকে সামান্য ছোট বা বড়। এভাবেই জীবন চলে ওদের। ওরা এতেই অভ্যস্ত।
গতকাল যে জামাকাপড় গুলো ওদের কাছে এসে পৌঁছেছে, বেশ কয়েকটার অবস্থা জীর্ণ। কারও পুরনো হয়ে যাওয়া বা ফেলে দেওয়া জামা কাপড়। কয়েকটার অবস্থা তবে বেশ নতুন। সেই কয়েকটা জামাকাপড় ছেলেটা ওর ভাইবোনদের দিয়েছে। জীর্ণ জামাটা বেছে নিয়েছে নিজের জন্য। এই সব কিছুর সঙ্গে ও মানিয়ে নিয়েছে। অনেকেই ওদের কাছে দিন বদলের গল্প শোনায়। আশা দেখায়। কাজ যে একেবারে হয় না তা নয়। তবে সবটাই সাময়িক। মূল অবস্থার বদল ঘটে না। ছেলেটা জানে, ওদের জীবন এভাবেই কাটছে, ভবিষ্যতেও কাটবে, অতীতেও এমনটাই কেটেছে। অবহেলায় মোড়া জীবনে থাকা এই ছেলেটির নাম জানাটা জরুরী নয়। আসলে ছেলেটা পথশিশু। শিশুদের স্বাভাবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত জীবন দিয়েই ওর জীবনটা শুরু হয়েছিল। জন্মের পর থেকেই অন্যের উদ্বৃত্ত খাবারে বা কারোর ফেলে দেওয়া জামা-কাপড়ে বড় হয়েছে ও। বেশিরভাগ পথশিশুর এমনটাই অবস্থা। এনজিও সংস্থাগুলি কাজ করছে ওদের জন্য,এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ওদের জীবনের বদল যে একেবারে আসছে না সে কথা বলাও ভুল, তবুও মূল অবস্থাটা কোথাও বদলাচ্ছে না।
তবে অনেক বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তাদের সকলের কাছেই মোটা অংকের কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি ফান্ড রয়েছে। এখান থেকেই তাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত সমাজসেবীদের দিয়ে পথশিশুদের জন্য কাজ করাচ্ছেন। এমনকি আমাদের খোদ কলকাতা শহরেও এই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলোর তরফ থেকে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় সমাজ কল্যাণ ইউনিট খোলা হয়েছে পথশিশুদের জন্য। ওপেন শেল্টার তৈরি করার ব্যবস্থা হচ্ছে। তবে সবটাই এখনো পরিকাঠামোর দিক থেকে ততটাও এগিয়ে যায়নি, যতটা এগোলে পথশিশুদের জীবনধারণের স্থায়ী বদল ঘটানো সম্ভব।
সারা পৃথিবীতে যত শিশু অপুষ্টিজনিত রোগে ভোগে তাদের মধ্যে অর্ধেকের বাস ভারতবর্ষে, এবং এরা বেশির ভাগই পথশিশু। তবে চিন্তার কথা যে, আমরা যারা সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে খানিকটা হলেও এগিয়ে প্রতিবছর অষ্টআশি হাজার কোটি টাকার খাবার নষ্ট করি, এমনটাই বলছে সমীক্ষা।
শুধু তাই নয় এই ধরনের পথশিশুদের অনেকেরই সঠিক পরিচয় পত্র নেই, ফলে নানা সরকারি সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। নেই জন্মের শংসাপত্র। তবে সরকারি তরফে এখন বেশ কিছু কাজ করা হচ্ছে।
দ্য ন্যাশনাল আরবান হেলথ মিশন-এর নির্দেশিকায় শহরাঞ্চলে আরবান হেলথ নিউট্রিশনের পাশাপাশি বিশেষ আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। খালপাড়, উড়ালপুলের নীচে বা রেললাইনের ধারে অপুষ্টিজনিত রোগে ভোগা শিশুদের একটি তালিকা তৈরি করার চেষ্টাও করা হচ্ছে।। পরিকল্পনা এমনই যে, ওই সমস্ত অঞ্চলে বিশেষ শিবির আয়োজন করে তাদের স্বাস্থ্যপরিসেবা দেওয়া হবে। এই বিষয়ে কাজ হচ্ছে গ্রামেও। সব মিলিয়ে চলছে একটা আলো খোঁজার চেষ্টা। দীপাবলির আলো এইসব অবহেলায় জীবন কাটানো শিশুগুলোর মুখে হাসি ফোটাক এমনটাই কাম্য।