বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতির ক্রমবিবর্তন

ভোজন রসিক বাঙালির ভোজন রসনার একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। মূলত ১৮ ও ১৯ শতক থেকে রসনার পরিতৃপ্তি ঘটাতে নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করে সমাজের ভদ্রলোক সম্প্রদায়। যার সূচনা আর্যদের আগমনেবৈদিক সাহিত্যে এই ব্যাখ্যা সুবিস্তৃত। অবশ্য সেখানে খাদ্যের বিভাজনসহ রীতি নীতি সবই উল্লিখিত। পরবর্তীকালে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাজার খাদ্যাভ্যাস, রান্নাঘরের যথার্থ মাপের বিবৃতি আছে। বাঙালির খাদ্যাভ্যাস এর ইতিবৃত্ত পাই মঙ্গল কাব্যে ও বৈষ্ণব পদাবলীতে।

                  বাঙালির স্বাদকে অনেকটা প্রভাবিত করে বিশিষ্ট মুগল ও ইউরোপীয়রা। পাশাপাশি শ্রী চৈতন্য বাঙালিদের খাদ্যাভ্যাসকে ব্যাপকভাবে পরিমার্জিত করেছিল। বৈষ্ণব উৎসবের  নিরামিষ সামগ্রী ছিল ঘি, শাক, মুগের ডাল, এবং পটল, বড়ি  অন্যান্য সবজি, ভাজা তাজা নিম পাতা, বেগুন  ভাজা, মোচা, নারকেল, পায়েস, কলা, মিষ্টি দই, দুধ এবং শুকনো চাল ইত্যাদি। চৈতন্য দেব গাছ পাঁঠা কে খাদ্য তালিকা ভুক্ত করেন। সেই থেকেই এঁচোড়ের যাত্রা শুরু। আলু বাঙালি খাবারের অংশ হয়েছে পর্তুগিজদের হাত ধরে। আনারস এবং পেঁপে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে তারাই আমদানি করত। আমিষের মধ্যে বিভিন্ন মাছ যেমন খারসুন, প্রন, রুই, চিতল এবং শোল প্রচলিত ছিলকচ্ছপের মাংসডিমের চাহিদা ছিল প্রবল।

               অষ্টাদশ শতকে বাঙালিদের খাবারের নব সংযোজন ছানার মিষ্টি। আগে বাঙালি সহজ দুধ-লাউ এবং মন্ডা দিয়ে সন্তুষ্ট হতো। কিন্তু বাংলায় পর্তুগিজরা ছানার আগমন ঘটানোর ফলে রসগোল্লা, সন্দেশ ও চমচম বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।এই উন্নতির জন্য নাগরিকীকরণ ও নগরায়নের গুরুত্ব কম নয়। এই যুগে মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, বিষ্ণুপুর ও কৃষ্ণনগর, ঢাকা ও নাটোর প্রধান নগর কেন্দ্র হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই ভদ্রলোক সম্প্রদায় সহজ দেশজ খাদ্যের সাথে আরো পরিশীলিত খাদ্য দাবি করেছিল। ইতিমধ্যেই মুঘলরা এই ভোজন রসনার অন্যতম কান্ডারি হয়ে ওঠে। শিক কাবাব দিয়ে ভাজা কচ্ছপের ডিম, কলিয়া, কবাব, কোফতা, কোমার,  পোলাউ এবং ভুনা, মুঘল শৈলীতে পেঁয়াজ, রসুন সহযোগে রান্না বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে

                          প্রায় একই সময়ে শহুরে বাঙালীর মধ্যে মাছের চাহিদা বাড়তে থাকেভেটকি, বাচা, কালবোস, পাবদা ও ইলিশের তালিকাভুক্ত নামগুলি আগে, গ্রামীণ কাব্যিক রচনাগুলিতে পাওয়া যায় নি। তবে, বেশিরভাগ ব্রাহ্মণ কিছু আধিপত্য বজায় রাখে। উৎসব উপলক্ষে লুচি, ছাক্কা, শাক ভাজা এবং বিভিন্ন মিষ্টি প্রাধান্য পেত সেই সময়। পাঁঠার মাংস রান্না হত রসুন, পেঁয়াজ বা সমৃদ্ধ মসলা ছাড়াকথিত আছে বর্ধমানের মহারাজার খাবারের ১৮ রকমের কাবাব থাকতো যা সম্রাট শাহজাহানের খাদ্যভাসের দ্বারা অনুপ্রাণিত। আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, পটল তখনও জনপ্রিয় ছিল না। বিয়ে ও উপনয়ন উৎসব উপলক্ষে মাংস হতো না। এমনকি লবণ ব্যবহার হতো না। খুব প্রয়োজন হলে সৈন্ধব লবনের ব্যবহার হত।

                         ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রাঢ় অঞ্চল এবং নিকটবর্তী এলাকায় একটি ভিন্ন রন্ধন প্রণালীও বিকশিত হয়েছিল। ভাত, কলাই ডাল,  সবজি,  পোস্ত, অম্বল এবং মাছের বিভিন্ন পদ হালকা মশলা এবং মৃদু আঁচে হতো যা সুস্বাদুও বটে। বর্ধমানের বিশেষত্ব ভাতকলাই ডাল , পোস্ত, বড়ি, কচু-কুমার ঘন্ট, পোস্ত - চিংড়ি। সাথে যুক্ত হলো বর্ধমানের সীতাভোগ ও মিহীদানা, শক্তিগড়ের লেংচা, মন্ডা, ছানা বড়া

                      নদিয়ার মিষ্টি তৈরির একটি গৌরবময় ঐতিহ্য ছিল। বেশিরভাগ বিখ্যাত মিষ্টি ছানার, যার মধ্যে সরপুরিয়া, সরভাজা,  সারতাখ্তি, শান্তিপুরের নিখুতী, মুরাগাছার জিলিপী এবং রানাঘাটের পান্তুয়া। এগুলি মূলত ঘিয়ে ভাজা এবং চিনির রসে ডোবানো। মালদহ রসকদমের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এছাড়াও বিখ্যাত ছিল জনাইয়ের মনোহরা, জঙ্গিপাড়ার পান্তুয়া, খানকুলের কালাকাঁদ, কামারপুরের জিলিপী, গৌড়তির রসকারা এবং শ্রীরামপুরের গুঁফো সন্দেশ। এতে কোন কৃত্রিম রং যোগ হতো না ।

                         ঢাকা অঞ্চল নিজস্ব স্বতন্ত্র খাদ্য সংস্কৃতি গড়ে তোলে। অমৃতী জিলিপী, মালাই, ছানা, প্রাণহরা সন্দেশ, মালপো, খাজা, লালমোহন, নন্দনখড়া এবং বখরখানি এর জন্য বিখ্যাত ছিল। ঢাকায় ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে নারকেল, কাসুন্দি, খেসারি ডাল, শালুক ডাঁটা, ভাজা নিম পাতা, আলু, কুমড়োর খোসা ভাজা, উচ্ছে মাছ, কাচকি মাছ খাস্তা ভাজা, ফুলকপি দিয়ে মাছের মুড়ো, নারকেল চিংড়ি, চিতল মুঠি, বড়ি  দিয়ে পাবদা মাছ, মুরগি এবং মাছ পেঁয়াজ, রসুন এবং মরিচ দিয়ে প্রচুর পরিমাণে রান্না করা হতোচিটাগং-এ পাওয়া মাছ ভদ্রলোকের ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত ছিল না। এদের মধ্যে শুকনো ছোট মাছ, তোপসে এবং লোটে। বরিশাল-বখরগঞ্জের মানুষ তেল, পেঁয়াজ, রসুন এবং অন্যান্য সবজি দিয়ে কাঁচা মাছ মিশ্রিত এবং লালচে অতি গুরুপাক খাবারের প্রতি আকৃষ্ট ছিল। সিলেট তার নারকেল তৈরি মিষ্টি জন্য পরিচিত ছিল।

                          পরিশেষে বলা যায় এই খাদ্য তালিকা বিভিন্ন সময় পরিবর্তিত হয়েছে অভিযোজনের মধ্য দিয়ে এবং যতই সুদীর্ঘ হোক না কেন বাঙালি আত্মীকরণের মাধ্যমে এই তালিকার রসাস্বাদনে এখনো পরম আনন্দিত বোধ করে চলছে, আধুনিকীকরণের মাধ্যমে তার বৃদ্ধিও হয়েছে।। তা সে যতই  স্বাস্থ্যসচেতন হোক না কেন ।  

 

                    

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...