কলকাতার পরিবহনের বিবর্তনের সেকাল ও একাল

    কলকাতার পরিবহনের বিবর্তনের সেকাল ও একাল চাকা মানুষের জীবনকে শুধু পাল্টায় নি তাতে নতুন একটি শব্দ ও মাত্রা সংযুক্ত করেছে তা হলো -গতি। এই গতিশীলতাই আজকের এই আধুনিক পরিবহনের বিবর্তনের সাফল্যের কারণ। যার অস্তিত্ব সেই কলকাতার জন্মলগ্ন থেকেই মিশে আছে আর তার ফলশ্রুতি এই অত্যাধুনিক জীবন। সেই সাথে আছে 'সময়ের প্রাধান্য, 'স্বাচ্ছন্দ্য'- এই গতিময়তা এতটাই মজ্জাগত হয়ে গেছে যে তার সাথে পা মিলিয়ে পরিবহন ব্যবস্থায় কালক্রমে এসেছে একাধিক বিবর্তন- যা প্রযুক্তিগত কারণে আরো সহজ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর প্রেক্ষাপট ঠিক কেমন ছিল? কলকাতাকে আজ আমরা যেমন দেখি সে তো নানা স্মৃতির পরত মেশানো এক প্রায় সাহেবি কলকাতা - কিন্তু যদি জন্মলগ্নের দিকে একবার ফিরে যাই তাহলে ঠিক কেমন ছিল সে পুরোনো কলকাতার যাতায়াত ব্যবস্থা? -আজ সেই গল্পই হোক।

                           জন্মলগ্ন থেকে ২১ শতকের এই যানবাহনের বিবর্তনের যাত্রাকাহিনী  শুরুতেই  যদি ২ ভাগে ভাগ করে নিই তাহলে বোঝার ক্ষেত্রে খানিক সুবিধে হবে। তা হলো স্বাধীনতার আগে ও পরে। ১৬৯০ সালের ২৪শে অগাস্ট যখন জব চার্ণক তৃতীয় ও সর্বশেষবারের জন্য সুতানুটিতে আসেন - তখন রাস্তার অস্তিত্বও অবস্থা সেভাবে বর্ণনীয় নয়। সুতানুটি, গোবিন্দপুর, কলিকাতা - তিনটি গ্রাম নিয়ে ছিল প্রাক কলকাতার অবিন্যস্ত রূপ। তখন যাতায়াতের মাধ্যম ছিল (স্থলপথে) পাল্কি, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি –( যদিও তা কিন্তু সর্বসাধারণের জন্য নয়)।

বিভিন্ন ধরনের পাল্কি দেখা যেত, যা সমাজের শ্রেণীবিভাজিকাও বলা যেতে পারে। সুতরাং আম জনতার  ভরসা ছিল পদব্রজে যাত্রা, গরুর গাড়ি, ফেরি ব্যবস্থা। যদিও পাল্কি ১৫০ বছর ধরে তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছিলো। তথ্যানুযায়ী  ১৮৩৯ পর্যন্ত ছিল ২৮৭৫ টি পাল্কি, ১১৫০০ জন বাহক ছিল, যা ১৮৯১ তে দাঁড়ায় ২৮৭৫টি ও বাহক ১৬১৪, ১৯১০ এর পর থেকে এর সংখ্যা তেমন হিসেবে আসে না - এককথায় লুপ্ত প্রায়। কারণ ছিল এই পাল্কি যেমন  সময় সাপেক্ষ, শ্রমসাধ্য, তেমন ব্যয়সাপেক্ষ ও  বটে। আর গতি বলতে সে শ্লথ - সেটাই স্বাভাবিক।  তাই প্রয়োজন হলো দ্রুত গতির।

                          মাধ্যম হলো ঘোড়ার  গাড়ি - যদিও  আধিক্য পরিলক্ষিত হয় হেস্টিংসের সময় থেকে। শহরের অভ্যন্তরে চলাচল ও দূরের পাড়ি জমাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভরসার কেন্দ্র ছিল এই ঘোড়ার গাড়ি। ১৯৮৭ সালে ৩৩ টি এই গাড়ির সন্ধান পাওয়া যায় যদিও আজ তার অস্তিত্ব ম্লান হয়ে শহরের বুকেই স্মৃতিচারণ করছে মূলত রাজাবাজার ও ধর্মতলা চত্বরে।  

                          বৈদ্যুতিক মাধ্যম ও ইঞ্জিনের আগে গতিময়তার একমাত্র সাক্ষী এই ঘোড়া। শুরু হলো ঘোড়ায় টানা বাস, ট্রাম। ১৮৭৩ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারী ঘোড়ায় টানা ট্রাম উদ্বোধন করেন লর্ড রিপন। এই সময় একটা ফার্স্ট ক্লাস ও ২টো সেকেন্ড  ক্লাস কাঠের তৈরী ট্রামের আগমন ঘটে। এখনকার সাথে যার কোনো সাদৃশ্যই পাওয়া  যাবে না।  টানতো  ২টো অস্ট্রেলিয়ান ঘোড়া - খরচ পড়ত ১.১৫ লক্ষ টাকা (বছরে) । মূলত  ৮থেকে ১০ জন ( প্রতি বগি) যাত্রী নিয়েই চলা শুরু হয়েছিল তবে পণ্য পরিবহনে কার্যকরী ছিল এই ট্রাম। কিন্তু  ব্যয় বাহুল্যতার কারণে বিকল্প  মাধ্যমের খোঁজ পড়ে। ১৮৮২ তে ট্রামে আসে গতি। তাতে প্রাণ সঞ্চার করে ১৮৯৬ সালে কিলবার্ন কোম্পানি - CTC কে  বৈদ্যুতিক ট্রামের প্রস্তাব দিয়ে। তার আধুনিকীকরণ ঘটে, রাস্তা বৃদ্ধি পায় - যদিও নানা হাত বদল হয়ে সেই ট্রাম আজও  চলমান তবে ঐতিহ্য হিসেবে। 

                      ১৮৫৪ থেকে গণপরিষেবার হাত ধরে রেল - হাওড়া স্টেশন তৈরির পর। ১৮৮৬ তে জার্মান ইঞ্জিনিয়ার গটিলেব ডেইলমের প্রথম মোটর চালিত গাড়ি উদ্ভাবন করেন এবং তার ১০ বছর পর কলকাতা সেই দ্রুততম যানটি প্রত্যক্ষ করে। ১৯০৬ থেকে বাঙালি আর শিখ ড্রাইভারদের দৌলতে ট্যাক্সি ব্যবস্থা ক্রমে প্রচলিত হতে থাকে।

                        শহরে চীনারা হাতে টানা রিক্সা নিজেদের প্রয়োজনেই মূলত ব্যবহার করতো যা ১৯১৩-১৪ সাল নাগাদ পাড়া সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে ওঠে। আরো ভালো করে বললে স্বল্প দূরত্বের জন্য প্রয়োজনীয় ওঠে। হাতে টানা রিক্সা ১৯৭২পর্যন্ত চললেও তা আজ কোনোক্রমে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

                        স্বাধীনতার পর এই পরিবহন ব্যবস্থার এক দ্রুত পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করলো কলকাতা। মূলত তার মালিকানার পরিবর্তন হলো - বাস ব্যবস্থায় জাতীয়করণ হয় ১৯৪৮ এ স্বাধীনতার পর, ট্রামের ক্ষেত্রে তা কিছুটা পর ১৯৬৭, ক্রমান্বয়ে অন্যান্য সংস্থার আগমন হলো cstc (১৯৬১), NBSTS (১৯৬০),  SBSTC (১৯৬৩)  আর ট্রামের ক্ষেত্রে CTC ও WBSTC এর ভূমিকা পরিলক্ষিত হয় ১৯৯২ সালে। ইতিমধ্যেই স্বাধীনতার পর  আরো একটি সফল পরিবহন পরিষেবার আত্মপ্রকাশ ঘটে - বিমান পরিষেবার, ১৯৫৩ সালের ১লা  অগাস্ট থেকে। এক শহর থেকে অন্য শহরে  যেতে ট্রেনের থেকে অনেক কম সময়ে পৌঁছে  যাওয়া সহজ হয়, জীবনের মান ক্রমোন্নত হতে থাকে আর তার মূল উদেশ্য গতি, সময়  সাশ্রয় - যদিও তা আম জনতার সাধ্যের  কিছুটা বাইরে ছিল - যদিও আজ আর তেমন বলা  চলে না।

                                   ক্রমবর্ধমান যাত্রীর চাহিদায় (মূলত দেশ ভাগের পর) এই পরিষেবা স্বাচ্ছন্দ্য রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। আর ঠিক সেই সময় বেসরকারি সংস্থা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনে। ১৯৬৬-৬৭ এ  রাস্তায় দেখা গেলো 'মিনি বাস'- কিন্তু এতো মানুষের নিত্য যাতায়াতে রাস্তা, বাস, ট্রাম এসব কিছুদিনের মধ্যেই সীমিত মনে হলো। তাই কিছুটা ভিন্ন পরিকল্পনায় উঠে আসে মাটির নিচে পরিবহন ব্যবস্থা- যা মেট্রো নামে পরিচিত। ১৯৮৪ সালে ২৪সে অক্টোবর জন্ম হলো আরো দ্রুততম, ট্রাফিক জটহীন এক পরিবহন মাধ্যম।

                        ১৯৮২সালে এক নতুন ধরণের গাড়ির আবির্ভাব ঘটে - কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য ও সময় সাশ্রয়ের কারণে তার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম হয়ে উঠলো। তা অটো রিক্সা - বর্তমানে যার সুবিধা আর দৌরাত্ম্য প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করি আমরা। এই স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখে এয়ার কন্ডিশন যাত্রী বাহি বাস,ট্রেনের প্রচলন ঘটে। সেক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্য একটা বিশেষ ভূমিকা নেয় আর এর সাথে আজ যা দেখি সমানভাবে পাল্লা দিতে রাস্তায় নেমেছে স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যম - বিভিন্ন গাড়ি - ভ্রাম্যভাস থেকেই  আঙুলের ছোঁয়ায় তা বাড়ির কাছে চলে আসে। বিজ্ঞান মানুষকে এতটাই উন্নত করেছে যে তার পরনির্ভরশীলতাও অনেক বেড়েছে, সে যাই হোক এতে প্রতিনিয়ত কর্মজীবন বা প্রয়োজনভিত্তিক চাহিদার যথার্থ সমাপন ঘটছে। আর ঐতিহ্যবাহী  কিছু যান এই প্রতিযোগিতার সাথে আজ ও  লড়ে  চলেছে তবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে।

এই হলো সেকালের কলকাতার  সাথে একালের কলকাতার বিবর্তনের  চিত্র  -  যার সাথে বিজ্ঞান, গতি, সময়, স্বাচ্ছন্দ্যের, আর্থিক কাঠামো, জীবনের মানোন্নয়ন সব কিছু মিশে আছে। আর আছে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গন্ধ।                   

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...