প্রায় ছ'শো বছরের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে এই দুর্গাপুজোর সঙ্গে

সময়টা আজ থেকে প্রায় ছশো বছর আগে। সন্তান রূপে এক মেয়ে এসেছেন বাবার কাছে। বাবার কাছে মেয়ে এসেছেন আকুতি জানাতে। সন্তান এসেছিলেন মেয়ে হিসেবে পুজো নিতে। শোনা যায় হুগলির আরামবাগের গড়বাড়ির রায় পরিবারে এভাবেই শুরু হয়েছিল দুর্গাপুজো।

গড়বাড়ির রায় পরিবারের ঐতিহ্যময় দুর্গাপুজোর কথা নাকি শ্রীরামকৃষ্ণর কথামৃত উল্লেখ রয়েছে। আরামবাগ শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গড়বাড়ি। সেখানকার রায় পরিবারের দুর্গাপুজো বিখ্যাত। এই রায় পরিবার আসলে রাজ পরিবার। রাজা রণজিত সিংহের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল দুর্গাপুজো। এই দুর্গাপূজো ঘিরে রয়েছে নানা ইতিহাস। নানা জনশ্রুতি। কথার পিঠে কথা ফেরে হাওয়ায় ভেসে।এই সব কথার ঘোরাফেরা করার বয়স প্রায় ছশো বছর। এই পুজোর কথা উল্লেখ রয়েছে রামকৃষ্ণের কথামৃতে।

শোনা যায় একজন রাজপুত যোদ্ধা ছিলেন। যুদ্ধই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র অবলম্বন। যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত এই যোদ্ধার মন একসময় পরিবর্তন হয়। যুদ্ধের রক্তক্ষয়, মানুষের হানি সেই যোদ্ধাকে ক্লান্ত করে।বিষন্ন, বিমর্ষ করেছিল। পরিবর্তিত মন নিয়ে সেই যোদ্ধা ফিরে আসেন আমাদের বাংলায়। তাঁর নাম রনজিৎ সিংহ। তৎকালীন আরবানগরীর গড়বাড়ি নামে এক জনপদে তিনি গড়ে তোলেন একটি প্রাসাদ। এই আরবানগরী আসলে আরামবাগ শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি অঞ্চল। সে সময় চারিদিক ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ছিল।

রনজিৎ সিংহ বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে গড়ে তোলেন প্রাসাদটি। যে মানুষ একসময় বহু লক্ষ মানুষের প্রাণ নিয়েছেন, তাঁর অন্তরে স্নেহ বাস করতে শুরু করে তখন। তিনি বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে জমিদারীর পত্তন করেন। কয়েকশো গ্রাম নিয়ে শুরু করেন রাজত্ব।

সে সময় রণজিৎ সিংহকে সকলেই ওই অঞ্চলের রাজা বলেই চিনত। কিন্তু কারোর কাছ থেকে তিনি রাজা উপাধি পেয়েছিলেন কিনা তাই নিয়ে নির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে পরবর্তীকালে রনজিৎ সিংহ নারায়ণ উপাধি পেয়েছিলেন। তাই তাঁর নাম পরিবর্তিত হয়ে রনজিৎ রায় নারায়ণ হয়। আজও আরামবাগের গড়বাড়ি অঞ্চলে রণজিৎ রায়-এর নাম বিখ্যাত। স্মৃতির পাতা এভাবেই অতীতের ডানায় ভর করে উড়ে বেড়ায় হুগলির আরামবাগ অঞ্চলে।

যুদ্ধের ক্ষেত্রে মন পরিবর্তিত হওয়ার পর রণজিৎ সিংহ তাঁর জীবনের অনেকটা সময় আধ্যাত্মিক ভাবনায় কাটিয়েছিলেন। নিজের সাধনা নিয়ে মগ্ন থাকতেন তিনি। ঈশ্বর সাধনা তাঁর কাছে বিশেষ অনুভবের বিষয় ছিল।

গড়বাড়ি অঞ্চলে রাজা রনজিৎ সিংহের হাত ধরে শুরু হওয়া দুর্গাপুজোর বিশেষ ইতিহাস রয়েছে। শোনা যায় রাজার সাধনায় তুষ্ট হয়ে একবার মা দুর্গা স্বয়ং শিশুকন্যা রূপে দেখা করতে এসেছিলেন রনজিৎ সিংহের কাছে।

রাজা রনজিৎ সিংহ নাকি স্বপ্নাদেশ পেয়ে ঘন জঙ্গল থেকে শিশু-কন্যা রূপে মা দুর্গাকে কুড়িয়ে বাড়ি নিয়ে যান। সেই কন্যারূপী মা সম্মান চেয়েছিলেন, আদর চেয়েছিলেন বাবার কাছে। দেবী দুর্গা তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিলেন " আমি মেয়ে হয়ে তোর কাছে থাকতে চাই। যতদিন না তুই নিজে চলে যেতে বলবি ততদিন তোর ঘরে মেয়ে হয়ে থাকবো। তবে একবার চলে যেতে বললে আর কখনো ফিরে আসব না।"

এই প্রসঙ্গে একটি অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে।

মেয়েকে নিয়ে বেশ কয়েক বছর রাজা রণজিৎ রায়ের ভালোই দিন কেটেছিল। কিন্তু পরে মা নাকি ফিরে যান স্বর্গে। জানা গেছে একদিন রাজা তাঁর রাজকার্য নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন। মেয়ে খুব বিরক্ত করছিল। রাজা কাজে মন দিতে পারছিলেন না। কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন। মা দুর্গা তখন রনজিৎ সিংহকে জানিয়েছিলেন "আমার কথা না শুনলে আমি কিন্তু চলে যাব।" রাজা কিন্তু কাজে ব্যস্ত তখন। মেয়ে বারবার একই কথা বলে চলেছেন। এ সময় রাজা কিছু না ভেবেই বলে বসেন "যা তোর যেখানে খুশি।" তারপর হঠাৎ করে আর মেয়েকে কোনদিন খুঁজে পাননি রাজা রনজিৎ রায়। একজন শাঁখাড়ি সেদিন এসে রাজাকে বলেছিল "তোমার মেয়ে আমার কাছে শাঁখা পরেছে, তার দাম দাও। মেয়ে বলেছে কুলঙ্গিতে পয়সা রাখা আছে।" শাঁখাড়ির কথায় রাজা তাঁর ভুল বুঝতে পারেন। শাঁখাড়ির কাছে জানতে চেয়েছিলেন মেয়ে কোথায়। শাখাড়ি তাঁকে দীঘির পাড়ে নিয়ে যায়। শোনা যায় মেয়েকে না পেয়ে রাজা তীব্র চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। মা দুর্গাকে ডাকতে থাকেন। দিঘির মাঝখান থেকে সেই সময় নতুন শাখা পরা দশটি হাত দেখা যায়, কিছু সময় পরই তা মিলিয়ে যায়।

জনশ্রুতি অনুযায়ী এই অলৌকিক ঘটনাটি ঘটেছিল চৈত্র মাসের কোন এক দিনে। সেই জন্যে এই অঞ্চলে চৈত্র মাসেও দিঘীর পাড়ের একটি মন্দিরে একটি দুর্গাপুজো হয়। দানমেলা বসে এই সময়। তবে রাজবাড়ীর ঐতিহ্য মেনে শরৎকালেও দুর্গাপুজো হয়। রাজ পরিবারের উত্তরসূরীরা এই দুর্গাপুজো নিষ্ঠাভরে পালন করেন। দুর্গাপুজো,অতীত সব মিলিয়ে হুগলির আরামবাগের গড়বাড়ির পুজো আজও নস্ট্যালজিয়া।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...