কালীপুজো আসলেই সবাই অপেক্ষায় থাকেন মায়ের দর্শনের জন্যে। চন্দননগর যেমন জগদ্ধাত্রীর, দুর্গাপুজো যেমন কলকাতার, তেমনই নৈহাটি কালীপুজোর জন্য বিখ্যাত। আর নৈহাটির কথা মনে পড়লেই সবার মুখে একটাই নাম- বড় মা। শুধু নৈহাটি নয়, সারা বাংলা চেনে এক ডাকে।
বাংলার বিখ্যাত ও জাগ্রত দেবী কালী হলেন নৈহাটির বড়মা। মায়ের টানে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ আসেন একঝলক শুধু দেখার জন্য। এই ক’টা দিন ভিড়ে ভিড়াক্কার হয়ে থাকে পুরো এলাকা। এই ভিড় বেশ ঐতিহাসিক। অনেকে এখানে এসে মায়ের কাছে মানত করেন, তাদের বিশ্বাস যে তাদের সেই মনোবাঞ্ছা পূরণ হবেই।
নৈহাটি স্টেশন থেকে বেরিয়ে পশ্চিম পাড়ে ঋষি অরবিন্দ রোড ধরে গঙ্গার দিকে একটু হাঁটলেই এখনও ’বড় মা’য়ের পুজো এখানেই হয়ে আসছে।
নৈহাটির বড় মায়ের ইতিহাস তো রয়েছে। সেই বিষয়ে আজ বলব। কিন্তু ভক্তদের মুখে মায়ের গল্প শুনলে শিহরিত হবেন আপনি! চলুন আজকে শুনে নিন মায়ের কিছু জানা অজানা গল্প।
প্রায় ১০০ বছর আগের কথা। এ পুজো শুরু করেছিলেন ভবেশ চক্রবর্তী। একদিন তিনি বন্ধুদের সাথে নবদ্বীপে ভাঙা রাসের মেলায় ঘুরতে গিয়েছিলেন। সেখানে অনেক বড় বড় মূর্তি হয় এবং সেইসব মূর্তি ভাসান দেওয়ার সময় টেনে টেনে ভাসান দেওয়া হয়। সেখানে মা কালীর এক বিরাট মূর্তি দেখে তাঁর মনে ইচ্ছা জাগে মায়ের পুজো করার। এরপর নৈহাটি ফিরলে, তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন মা। যে, ‘আমাদের বাড়ির পুজোটা বড় করা যেতে পারে’। ভবেশ চক্রবর্তীর ইচ্ছে অনুযায়ী উচ্চতা হবে ২২ ফুট এবং ১৪ হাত। তারপরে বাড়িতেই শুরু হয় মায়ের পুজো।
ঠিক লক্ষ্মীপুজোর দিন, একটা কাঠামোর ওপরে, চাকা দেওয়া একটা ট্রলি তৈরি করেন। সেই ট্রলিতে মা-কে দাঁড় করানো হবে। সেদিন থেকেই বাঁশ পড়ে যায় এবং মা-কে তৈরি করা হয়। জানা গিয়েছে যে, দেবী মূর্তি তৈরি হয় নবদ্বীপে সেই দেখে আসা মূর্তির আদলেই। প্রতি বছরই সেই প্রতিমার উচ্চতা বাড়ানো হত। তাই বাড়িতে পুজো করা আর সম্ভব হচ্ছিল না। তখন ঋষি অরবিন্দ রোডের পাশে প্রতিমা বানিয়ে পুজো শুরু হয়।
প্রথম দিকে এই পুজোর নাম ছিল ভবেশ কালী পুজো। মায়ের নাম ছিল ভবেশ কালী হিসেবে। তবে বিভিন্ন 'অলৌকিক' ঘটনার জেরে ভক্তদের কাছে ভবেশ কালী ‘বড় মা’ হিসাবে পরিচিত হতে থাকেন। রীতি মেনেই এখনও কোজাগরী লক্ষীপুজোর দিন থেকেই প্রতিমা বানানোর কাজ শুরু হয়।
এটাই হল মায়ের ইতিহাস। এবার একজন ভক্তের গল্প বলব। কিভাবে তিনি ‘বড় মা’য়ের ভক্ত হলেন?
২০১৮ সালের গল্প।এক ব্যক্তি কালীপুজোর সময় বড় মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল দুজন ভদ্র মহিলা এসে হাউহাউ করে কাঁদছেন মায়ের সামনে। তিনি চিন্তিত হয়ে তাঁদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল এত কাঁদছেন? মা-কে দর্শন করুন। মায়ের কাছে চান।”এই শুনে এক মহিলা বললেন, “আমার একটা চাকরি আটকে আছে। মেট্রো রেলের চাকরি।” এই কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি বললেন, “মায়ের কাছে চান। পরের বছর আমি এই জায়গায় এখানে দাঁড়িয়ে থাকব। আপনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন এবং চাকরি নিয়ে।” তাঁর কথা সত্যি হয়ে গিয়েছিল। ভদ্র মহিলা পরের বছর এসে সেখানেই দাড়িয়েছিলেন, তাঁকে দেখে, মহিলাটি জানান “চাকরি হয়ে গেছে!”
প্রতি বছর ‘বড় মা’য়ের মহিমার কারণেই দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন হাজার হাজার ভক্ত।
জানা গিয়েছে ২০১২ সালে ভবেশ চক্রবর্তীর ছেলের হাত থেকে কর্তৃপক্ষের হাতে দায়িত্ব আসে। এই বছর পুজো একশো বছরে পড়ল। সেই কারণে মায়ের কষ্টি পাথরের ছোট মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে একশো ঘন্টা ধরে ভোগ বিতরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং একশোটি বৃক্ষ রোপণও করা হয়েছে।
প্রত্যেক বছর মায়ের মূর্তিকে একশো কেজি সোনা দিয়ে সাজানো হয়। বর্তমানে মায়ের জন্য ১০০ ভরি সোনা ও ২০০ ভরি রুপোর গয়না রাখা আছে। কমিটি থেকে জানা গিয়েছে যে প্রতিবছর কেউ একটা টিকলি দান করেছেন, কেউ একটা চোখ দান করেছেন, সেসব এক জায়গায় করে আজ ১০০ ভরি সোনায় মা-কে সাজানো হয়।
এখানে একদিন নয়, টানা পাঁচদিন ধরে চলে বড় মা’র পুজো। বিসর্জনের দিন দেবীমূর্তিকে ফুলের সাজে সাজিয়ে গোটা এলাকায় বিশাল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। স্থানীয়দের থেকে শোনা যায় যে বড় মায়ের বিসর্জন না হওয়া পর্যন্ত নৈহাটির অন্য কোনও কালীমূর্তিকে বিসর্জন করা যায় না। এছাড়া আলোর কার্নিভালও আয়োজন করা হয়।