রায় রামানন্দ কীভাবে বুঝতে পারলেন চৈতন্য মহাপ্রভু স্বয়ং ভগবান?

শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু এবং রায় রামানন্দের প্রথম সাক্ষাৎকার হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই দুজন দুজনের প্রতি ভাবে বিগলিত হয়ে উঠেছিলেন। রায় রামানন্দ প্রথম সাক্ষাতেই চৈতন্য মহাপ্রভুকে মহাপুরুষ রূপে চিনতে পেরেছিলেন, কিন্তু চৈতন্য মহাপ্রভু যে সাক্ষাৎ ভগবান! তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গোরা চাঁদ যে রাসলীলার অবতীর্ণ হওয়া স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ- সেটা তিনি সেই মুহূর্তে বুঝতে পারেননি। এরপর মহাপ্রভু যখন রামানন্দ রায়ের সঙ্গে বৈষ্ণব ধর্মের অত্যন্ত গোপন তত্ত্ব অর্থাৎ সাধ্য সাধন তত্ত্ব আলোচনা করেন, তখন রামানন্দ রায় বুঝতে পারেন চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রকৃত স্বরূপ। কী এই সাধ্য সাধন তত্ত্ব? যে তত্ত্ব জিজ্ঞেস করা মাত্রই রায় রামানন্দ বুঝে যান চৈতন্য মহাপ্রভুর আসল স্বরূপ! আজকের প্রতিবেদনে সেই তত্ত্ব কথাই জেনে নেব সহজ ভাষায়।

বৈষ্ণব ধর্ম অনুসারে শ্রী রামানন্দ রায় ছিলেন দ্বাপর যুগের বিশাখা সখী, (মতান্তরে ললিতা সখী) অর্থাৎ যিনি স্বয়ং রাসলীলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন রাধা কৃষ্ণের সঙ্গে। তাই কলি যুগে যখন চৈতন্য মহাপ্রভু আবির্ভূত হলেন তখন সকল পরিষদের মধ্যে রায় রামানন্দ তার কাছে অধিক প্রিয় হয়ে উঠলো। সন্ন্যাস গ্রহণের পরে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু যখন দক্ষিণ ভারতে ভ্রমণ করছিলেন তখন গোদাবরী নদীর তীরে একদিন রামানন্দ রায়ের সঙ্গে মহাপ্রভুর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। প্রথম সাক্ষাতের পর তাদের উভয়ের দেহে শিহরণ , কম্পন, অশ্রু ইত্যাদি সাত্ত্বিক ভাব জেগে ওঠে। এমনকি চৈতন্য মহাপ্রভু নিজের বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েন। সেখানে উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে ভাবতে থাকেন যে এমন অপূর্ব সন্ন্যাসী কেন রায় রামানন্দকে এভাবে জড়িয়ে ধরলেন এবং নিজের জ্ঞান হারালেন? এরপর মহাপ্রভু বাইরের মানুষের সামনে নিজেকে সংযত করেন এবং রামানন্দ রায়কে পরে দেখা করতে বলেন।

অন্যদিকে রামানন্দ রায় ও মহাপ্রভুর সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ করবার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠেন। সেদিন সন্ধ্যায় গোদাবরীর নির্জন তীরে আবার এসে উপস্থিত হন রায় রামানন্দ এবং চৈতন্য মহাপ্রভু। এরপর তাদের মধ্যে সারারাত কৃষ্ণ তত্ত্ব কথা আলোচনা হয়। এই তত্ত্ব কথার মধ্য দিয়েই উন্মোচিত হয় চৈতন্য মহাপ্রভু এবং রায় রামানন্দের স্বরূপ। সেই রাত্রে চৈতন্য মহাপ্রভু রায় রামানন্দকে জিজ্ঞেস করেন কিসে বিষ্ণু ভক্তি হয়? রামানন্দ রায় বলেন কোনও ব্যক্তি যদি নিষ্ঠা ভরে নিজের স্বধর্ম আচরণ করেন অর্থাৎ সত্য নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের যাবতীয় দায়িত্ব ভক্তি ভরে পালন করেন তাহলে তার বিষ্ণুভক্তি হয়। মহাপ্রভু তখন বললেন, ধর্মের এই যে কথা তুমি বলছো এটি বাহ্যিক, এর আগেও কিছু আছে সেটি বল।

এরপর রায় রামানন্দ বললেন ভক্তির অপর একটি স্তরের কথা যেটি গীতায় বর্ণিত হয়েছে। রায় রামানন্দ বললেন, কৃষ্ণের চরণে সমস্ত কর্ম সমর্পণ করতে হবে। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি যা কিছু করে, খায়, দান করে তার সমস্ত কর্মফল কৃষ্ণকে প্রদান করতে হবে, এর মধ্য দিয়েই প্রকৃত ভক্তি হয়। যেকোনও ব্যক্তিকে এই কথা সন্তুষ্ট করে দেবে কিন্তু স্বয়ং গীতা বলেছেন যিনি সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ কলির চৈতন্য মহাপ্রভু এই বক্তব্যে সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি বললেন এটিও বাহ্যিক এর আগেও কিছু কথা আছে সেগুলি বলো।

রামানন্দ রায় তখন ভক্তির গভীরের তত্ত্বকথা প্রকাশ করে চৈতন্য মহাপ্রভুকে বললেন, সমস্ত কর্ম ত্যাগ করে কেবল ভগবান কে অনুসরণ করার বিধান গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দিয়েছেন, এমনটা করলে ব্যক্তি কোন কিছুর জন্য শোক করেন না , এটিই ভক্তির আসল কথা। চৈতন্য মহাপ্রভু বললেন এটিও বাহ্যিক। রামানন্দ রায় তখন বললেন, একজন ব্যক্তির যখন ব্রহ্ম স্বরূপের জ্ঞান হয় তখন সে সুখ-দুঃখ-বাসনা থেকে মুক্তি পায়। মহাপ্রভু বললেন এটিও বাহ্যিক, এর আগেও কিছু আছে। তখন রায় রামানন্দ বললেন, জ্ঞানশূন্য ভক্তির কথা- অর্থাৎ ব্রজবাসীরা যেমন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান রূপে নয় , আত্মীয় জ্ঞানে ভালোবেসে ছিলেন এবং তা থেকেই তাদের ভক্তি লাভ হয়েছিল। তেমনভাবে ভগবানকে নিজের আপনার মানুষ ভেবে গ্রহণ করলে ভক্তি হয়। চৈতন্য মহাপ্রভু বললেন, তুমি যা বলছ সেটা ঠিক তবে ভক্তির জন্য এটিই শেষ নয়, তিনি এরও আগে কিছু থাকলে সেটা শুনতে চাইলেন।

রায় রামানন্দ তখন বললেন প্রেম ভক্তি সর্বসাধ্যসার, অর্থাৎ শর্তহীন ভাবে ভগবানকে ভালবাসতে হবে। তখন চৈতন্য মহাপ্রভু বললেন, এটিও ঠিক আছে তবে যদি আরও কিছু থাকে তাহলে আমাকে জানাও। রায় রামানন্দ তখন দাস্যপ্রেমের কথা বলেন, যেখানে ভক্ত ভগবানের দাস হয়ে সেবা করে, কিন্তু চৈতন্য মহাপ্রভু তাকে বললেন আরও আগে কিছু আছে সেটা বল। এরপর রায় রামানন্দ সখ্য প্রেমের কথা বললেন, শ্রীকৃষ্ণের বন্ধু সুদামা যেমন ভাবে শ্রীকৃষ্ণকে বন্ধু ভেবে ভালবেসেছিলেন, সেই প্রেমের মধ্য দিয়ে ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায় বলে শাস্ত্রে বর্ণিত আছে। কিন্তু মহাপ্রভু এর আগেও কিছু আছে বলে সেটি শুনতে চাইলেন।

এরপর রায় রামানন্দ বললেন যশোদার ভগবান লাভের কথা, অর্থাৎ বাৎসল্যপ্রেমের কথা। যশোদা যেভাবে শ্রীকৃষ্ণ কে নিজের সন্তান রূপে ভেবে ভালোবেসে ছিলেন এবং এই ভাবেই ভগবানকে পেয়েছিলেন- এই পথ অবলম্বন করলে ভগবান লাভ সম্ভব। চৈতন্য মহাপ্রভু বললেন এটি উত্তম, কিন্তু আমি আরো জানতে চাই। রামানন্দ রায় তখন অশ্রু সজল চোখে কান্ত ভাবের কথা বললেন, অর্থাৎ যে ভাব রাধারানী এবং গোপীগনের মধ্যে ছিল, যে ভাব সাধারণ মানুষের পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয় সেই ভাবের কথা বললেন রামানন্দ রায়। রামানন্দ রায় ভেবেছিলেন শান্ত, দাস্য, সখ্য , বাৎসল্য এই চারটি ভক্তির কথা শুনে মহাপ্রভু তৃপ্ত না হলেও কান্ত প্রেমের কথা শুনে তিনি তৃপ্ত এবং সন্তুষ্ট হবেন কারণ ভক্তির ক্ষেত্রে এটি সর্বোত্তম। কিন্তু রায় রামানন্দকে অবাক করে মহাপ্রভু বললেন, কান্ত প্রেমের এই ভাব ভক্তির চূড়ান্ত সীমা, তবে এরপরেও যদি কিছু থাকে সেটা আমাকে বলো।

রায় রামানন্দ তখন বললেন, আমি এটা জানতামই না যে, এই পৃথিবীতে এমন কেউ আছেন, যিনি কান্তভাবের আগেও জিজ্ঞেস করতে পারেন। কারণ কান্ত ভাবের আগে ব্যাখ্যা করতে হলে রাসলীলা ব্যাখ্যা করতে হয় আর রাস লীলার ব্যাখ্যা না সাধারণ ভক্ত করতে পারেন আর না যে কোন সাধক এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেন। কান্ত ভাবের পরে আর কী আছে? রাসলীলার ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া- এরপরেই রায় রামানন্দ বুঝে যান চৈতন্য মহাপ্রভু একজন মহাপুরুষ মাত্র নন তিনিই রাসলীলাকারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। অন্যদিকে রাসলীলা ব্যাখ্যা করা কোন সাধারন ভক্তের পক্ষে সম্ভব নয়, নিজে স্বয়ং সেই রাস লীলায় অংশগ্রহণ না করলে যে কেউ এই লীলা ব্যাখ্যা করতে পারেন না, এ থেকেই প্রমাণিত হয় রামানন্দ রায় দ্বাপর যুগে সখী হিসেবে ছিলেন রাসলীলায়। এইভাবেই রামানন্দ রায়ের কাছে চৈতন্য মহাপ্রভু নিজের স্বরূপ উদঘাটন করেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...