‘নব আনন্দে জাগো’।...
এমন একটা সময় ছিল যখন পয়লা বৈশাখের দিন ভোর বেলা কলকাতাবাসীর ঘুম ভাঙত প্রভাতফেরির এই গানে। সেই সময় বাংলা বছরের প্রথম দিনটা একটু অন্যভাবে শুরু ও শেষ করতে চাইত বাঙালি। সকালের প্রভাতফেরির গান শুনে সম্ভব হলে সেই দলে পা মিলিয়ে বাড়ি ফেরার পর বাড়ির কর্তার কাজ ছিল এলাকার সবথেকে বড় বাজারে গিয়ে রেওয়াজি পাঁঠার মাংসের দোকানে লাইন দেওয়া। আর তার ফরমাইশমতো এটা ওটা রান্না করে পাত সাজানোর দায়িত্বে থাকতেন তাঁর পতিব্রতা গিন্নি। এই দায়িত্ব গিন্নির কাঁধে আসলে কেউ চাপিয়ে দেন না। তিনি নিজেই এই দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন শ্বশুরঘরে আসার দিন থেকেই।
মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল, গলদা চিংড়ি, কচি পাঁঠার ঝোল, চাটনি সহযোগে চেটেপুটে পাত পরিষ্কার করে দুপুরে একটা লম্বা ঘুম। এরপর সন্ধে নামলে কর্তা-গিন্নিতে মিলে রিকশায় চেপে সোনার দোকানে বা কাপড়ের দোকানে হালখাতা সারতে যাওয়া। হাতে ক্যালেন্ডার আর মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফিরে মিষ্টি বিতরণ- এই ছিল বাঙালির পয়লা বৈশাখের রুটিন। আজও যে এই চিত্র দেখা যায় না এমনটা নয়। তবে দাপট কমেছে। পালটে গেছে পয়লা বৈশাখের চিত্র। পোশাক আশাক থেকে শুরু করে সারাদিনের রুটিন, বিশেষ করে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে বাঙালি। বাঙালি আজ অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন। তেল-ঝাল-মশলার দৌরাত্ম আজ অনেক কমেছে তাদের রান্নাঘরে। তবে হ্যাঁ, পয়লা বৈশাখে বাঙালি একটু নিয়ম ভাঙে। এদিন খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কোনও ‘না’ তারা মেনে নেয় না। কবজি ডুবিয়ে সেদিন খাওয়াদাওয়া সারে প্রায় সকলেই। কিন্তু পরিবর্তন তো একটা এসেছেই। এই বিশেষ দিনে বাঙালি ছোটে বড় কোনও রেস্তোরাঁয়। সত্যি কথা বলতে কি, পরিবারপ্রথা ভেঙে মাথাচাড়া দিয়েছে ‘তোমার আমার সংসার’-এর কনসেপ্ট। অর্থাৎ গড়ে উঠছে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। তাই কেটে, বেটে, রেঁধে, বেড়ে ঘাম ঝরানোর ধারপাশ দিয়ে হাঁটতে চান না অনেকেই। তাতে খাটুনি আর ঝক্কি অনেক। এই দিনটা একটু স্পেশাল। তাই নো বাজারহাট, নো তেলমশলার ঝাঁঝ, নো বাড়তি খাটুনি। সকালের পুজো অর্চনা সেরে বেলা ১ টা বাজলেই তারা পৌঁছে যায় কোনও রেস্তোরাঁয়। অনেক রেস্তোরাঁ এদিন বাঙালি থালির আয়োজন করে। চকচকে কাঁসার থালায় খাবার সার্ভ করে অনেক রেস্তোরাঁই। তাতে থাকে ঘি ভাত, পঞ্চশাক, মশলা ডাল, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, কচি পাঁঠার মাংস, আমের চাটনি, রসগোল্লা, দই সহ না জানি আরও কত পদ। এত সব কিছু যদি একটু টাকা খরচ করলেই মিলে যায় কে ঘরে বসে কষ্ট করে বলুন দেখি? সুস্বাদু বাঙালি খাবারের পাত দেখে নিজেকে খাঁটি বাঙালি ভাবার এই সুযোগ কেউ ছাড়ে?
বাঙালির এই দিনের আনন্দ-ফূর্তিতে মেতে ওঠার ধরনেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। হুতোমের বাবুরা নববর্ষের দিনে চুনোট করা ধুতি আর গিলে করা পাঞ্জাবি পরে লাল পাড়ায় যেতেন চেনা ছকের বাইরে অর্থাৎ একটু অন্যভাবে সময় কাটাতে। আজও এই বিশেষ দিনে বাবুরা যান সেই চেনা ছকের বাইরে। তাঁদের পরনে থাকে কোচানো ধুতির বদলে পাজামা-পাঞ্জাবি। ডেস্টিনেশন ফ্যামিলি বার। তাঁরা আবার গিন্নি সহযোগে যান এদিন। পরকীয়ায় মন মজে থাকলেও এদিন নিজের গিন্নিটিকেই সময় দেন তাঁরা। ব্যতিক্রমীরাও রয়েছেন। যারা নিজের গিন্নিটিকে ছাড়া নড়েন না এপাশ ওপাশ।...
বলা বাহুল্য, দিকে দিকে গজিয়ে উঠেছে কত শত ফ্যামিলি বার। সেখানে খানাপিনা থেকে শুরু করে নাচ-গান-মৌজ-মস্তি সবই চলে। সেখানে শামিল হয়েই বছরের শুরুর দিনটা আজ কাটিয়ে দেন একাংশের বাঙালি। সুতরাং বলতে দ্বিধা নেই, বদলে গেছে পয়লা বৈশাখের রুটিন, বদলে গেছে হালখাতার ছবি, বদলে গেছে বাঙালি। তবে, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে যাওয়া দোষের নয়। কিন্তু সবকিছুতে যাতে বাঙালিয়ানা বজায় থাকে সেই প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হতে হবে আপামর বাঙালিকে। নব আনন্দে জেগে উঠতে হবে খাঁটি বাঙালি হয়ে।