কালীপুজো বা দীপাবলি মূলত আলোর উৎসব। আলোর উদযাপনের মেতে উঠি আমরা। তবে দেবী কালী কিন্তু দনুজদলনী মহাশক্তিরূপেও পূজিত হন। যে মহাশক্তির কাছে নত হয় বাকি সকল শক্তি। কালীপুজো আসলে মাতৃশক্তির উত্থানের কথা বলে। মাতৃশক্তিকে নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্ত পুজোর কথা বলে।
কালিকাপুরাণ মতে দেবী কালীর মোট আটটি রূপ রয়েছে। আটটি রূপেই পূজিত হন তিনি। প্রত্যেকটি রূপের পুজোর আচার আলাদা। এমনকি পুজো করার সময়ও আলাদা। তবে কিছু মতে মোট নয় প্রকার কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, কালকালী, গুহ্যকালী, কামকলাকালী, ধনকালিকা, সিদ্ধকালী, চন্ডিকালিকা।
দেবীর এই নয়টি রূপ শক্তির প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি রূপ দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের কথা বলে। মহা শক্তির কাছে নত হওয়ার কথা বলে। দেবীর আটটি রূপের কথা জেনে নেওয়া যাক।
দক্ষিণাকালী- কালী প্রতিমার মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত এই দেবী মূর্তি। স্বয়ং মৃত্যুদূত যম যে কালীর ভয়ে পালান তার নাম দক্ষিণাকালী। মায়ের এই রূপের গলায় থাকে মুণ্ডমালার হার, কানে দুই ভয়ানক কর্নাবতংস, কোটিদেশে নরহস্তের কোটিবাস। কালীর এই রূপ ত্রিনয়নী এবং মহাদেবের বুকে দন্ডায়মান।
ভদ্রকালী- যিনি মরণকালে জীবের মঙ্গল বিধান করেন, তিনি ভদ্রকালী। শাস্ত্রে যদিও ভদ্রকালী নামটি দুর্গা ও সরস্বতী দেবীর অপর নাম হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে। কালিকাপুরাণ মতে ভদ্রকালীর গায়ের রং অতসী ফুলের মত। মা কালীর এই রূপের মাথায় রয়েছে জটা, কপালে অর্ধচন্দ্রাকৃতি ত্রিনয়ন, গলায় কন্ঠহার। তবে তন্ত্র মতে এই ভদ্রকালী কৃষ্ণবর্ণা, কোটরাক্ষী, সর্বদা ক্ষুধিতা, মুক্তকেশী। এই দেবী আসলে জগতের অন্ধকারকে গ্রাস করেন।
গুহ্যকালী- দেবীর এই রূপ মূলত সাধকদের আরাধ্য। গুহ্যকালীর বর্ণ মেঘের মতো। দুটি হাত তার। ৫০টি নরমুন্ডের মালা থাকে গলায়। কোমরে ছোট্ট কৃষ্ণ বস্ত্র, মাথায় জটা ও অর্ধচন্দ্র থাকে। কর্ণে শবদেহীরূপী অলংকার। তার বাঁ হাতে তক্ষক সর্পরাজ অবস্থান করেন। ডান হাতে অনন্ত নাগরাজ, তিনি নবরত্ন ভূষিতা। গুচ্ছ কালী নিয়মিত শবমাংস খান।
সিদ্ধ কালী- এই কালীর রূপ সেভাবে বাড়িতে বা উৎসবে পূজিত হয় না। যাঁরা আরাধনার মাধ্যমে সিদ্ধিলাভ করেন, মূলত তারাই সিদ্ধ কালীর পুজো করে। কালীতন্ত্রে তাঁকে দ্বিভুজার রূপে কল্পনা করা হয়েছে। সিদ্ধকালী সালংকারা। তার এক পা শিবের বুকে এবং অন্য পা শিবের উরুদয়ের মাঝখানে স্থাপিত।।
চামুন্ডাকালী- ভাগবত পুরাণ ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে চন্ড ও মুন্ড নামের দুই দৈত্যের হত্যার জন্যেই দেবী দুর্গার ভ্রুকুটি থেকে চামুন্ডা কালীর সৃষ্টি হয়েছিল। পুরান অনুযায়ী এই দেবী বাঘের চামড়া পরিধান করেন এবং দেবী অস্থি চর্মসার। এছাড়াও এই রূপে দেবীর দন্ত বৃহদাকৃতি।
মহাকালী- তন্ত্রসার গ্রন্থ মতে মহাকালী পঞ্চবক্তা ও পঞ্চদশ নয়না। তবে শ্রী শ্রী চন্ডিতে দেবীকে আদ্যাশক্তি, দশভুজা রূপে কল্পনা করা হয়েছে। তাঁর দশ হাতে রয়েছে অস্ত্র। খড়্গ, চক্র, গদা, ধনুক, বাণ, পরিঘ, শূল, ভুসূন্ডি, নরমুন্ড ও শঙ্খ।
শ্মশান কালী- শ্মশানে বাস করেন এই দেবী। সিদ্ধ কালীর মতো এই কালীর পুজো গৃহস্থের বাড়িতে হয় না। কথিত আছে প্রাচীনকালে কোন এক ডাকাতের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এই পুজোর। মূলত ডাকাতরা তাঁদের অভিযানে বেরোনোর আগে শ্মশানে পুজো করতেন এই কালীর।
রক্ষাকালী- রক্ষাকালীকে দক্ষিণা কালীরই একটি নাগরিক রূপ হিসেবে ধরা হয়। প্রাচীনকালে নগর বা লোকালয় রক্ষার জন্য এই দেবীর পূজা করা হতো। এই দেবীর মন্ত্র আলাদা, এমন কী স্থান ভেদে এই দেবীর বাহন পরিবর্তিত হয়। কিছু ক্ষেত্রে এই দেবীর বাহন সিংহ।
তবে প্রত্যেকটি রূপই শক্তির প্রকারভেদ। বিভিন্ন রূপে মাতৃশক্তির পুজো করে আপামর বিশ্ববাসী। এভাবেই আলোর কাছে নত হয় আঁধার।