আলেকজান্ডার পোপ বলেছিলেন, ‘কবি হতে গেলে প্রয়োজনে বাবা-মা, ঘর... সব ছাড়তে হবে’।
হিন্দু কলেজে তখন শিক্ষক-ছাত্রের পোশাকরীতি ছিল। তিনি কিন্তু কলেজের শুরুর দিন থেকেই সাহেবি পোশাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সকলকে।
বন্ধুরা দেখেছেন, বাবার সামনে ধূমপান করছেন তিনি। এমনকি বাবা-ছেলে একত্রে মদ্যপানও করছেন।
বন্ধুকে লিখেছিলেন যে কয়েক জন যদি দু’টাকা দিয়ে তাঁর বইটা কেনেন। আরও জনা চল্লিশেক গ্রাহক যদি জোগাড় করা যায়, তা হলে বই ছাপার খরচটুকু উঠে আসে।
তিনি বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের জনক। শ্রী মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
তাঁর হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য নাটক ও প্রহসনের রাস্তায় হেঁটেছে। চিনেছেন মুক্ত ছন্দের পথ। তিনিই বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের কাণ্ডারি।
এভাবেই তাঁর কবিতায় অতলান্তিক পেরিয়ে সুদূর অ্যালবিয়নের তীরে সুউচ্চ পর্বত, শ্যামল উপত্যকা দেখার আকুলিবিকুলি। স্বজনহীন প্রবাসে এক নামহীন সমাধির জন্য দীর্ঘশ্বাস।
হিন্দু স্কুলে থাকাকালীন সান্নিধ্যে আসেন ডেভিড রিচার্ডসন লেস্টারের। সেই শুরু ইংরাজি সাহিত্যে যাপন। রক্তে স্বপ্নরা ডানা মেলতে শুরু করেছে। বুঝলেন সাগরপারে না গেলে প্রতিষ্ঠা ধরা দেবেনা।
প্রথম কাব্য ইংরাজিতে। দ্য ক্যাপটিভ লেডি। বেথুন সাহেব পড়ে বলেছিলেন ইংরেজিতে না লিখে মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা করলে নেটিভ লিখিয়েদের কাজে দেবে বেশি।
মাইকেলের মন ভাঙল। কিন্তু লাভটা হল ভবিষ্যৎ বাংলা সাহিত্যের। ইংরেজিতে এর পরে আর কাব্য লেখেননি তিনি, তাঁর জীবনে এল বাংলা কাব্য, সাহিত্য।
মানসিক দ্বন্দ্ব, আর নিদারুণ দারিদ্র্যই যেন তাঁর কালি ও কলম। ৪৯ বছরের ছোট জীবন একদিকে যেমন ছিল সৃষ্টিতে থইথই। অন্যদিকে দুঃখ, কষ্ট আর যন্ত্রণার এক অনিভন্ত অগ্নিকুণ্ড ।
সন্তানের জন্মের খুশিতে জমিদার পিতা প্রজাদের রাজস্ব কমিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সন্তানকেই একদিন ত্যাজ্য করলেন- কেউ কি আঁচ করেছিল?
প্রথম স্ত্রী ,রেবেকা— মধুসূদন-ঘরনী।প্রেমের মায়াজালে আরও একবার ঘিরেছিলেন নিজেকে। আমৃত্যু অক্ষুণ্ণ ছিল সেই বন্ধন। তিনি এমেলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়া হোয়াইট— হেনরিয়েটা নামেই চেনেন সবাই।
ইংরেজি সাহিত্যচর্চার আগ্রহে ছুটে গিয়েছিলেন সুদূর ফ্রান্স পর্যন্ত। কিন্তু নিজ দেশ ও নিজ ভাষার মতো আশ্রয় তাকে কেউ দেয়নি।
সাহিত্যের অমৃত আস্বাদনের স্বাদ পূরণ হয় বাংলা সাহিত্যচর্চার মাধ্যমেই। বাংলা সাহিত্যও যেন ধন্য হয় তাকে পেয়ে। এই মেলবন্ধনে একে একে বাংলা সাহিত্যের খনিতে জমা হতে থাকে 'শর্মিষ্ঠা', 'পদ্মাবতী', 'কৃষ্ণকুমারী'র মতো নাটক।
তিনিই প্রথম বাংলায় লেখেন প্রহসন 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' ও 'একেই কি বলে সভ্যতা'। 'পদ্মাবতী' নাটকের মাধ্যমে তিনিই প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করেন।
তাঁর কাব্যগ্রন্থের তালিকায় রয়েছে 'তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য', 'মেঘনাদবধ কাব্য', 'ব্রজাঙ্গনা কাব্য' ও 'চতুর্দশপদী কবিতাবলি'।
মাইকেল আজও স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা এক সুবিশাল ঢেউ। সেই ঢেউ কখনও মিশে যেতে চায়নি অতল সমুদ্রে। ছাপিয়ে যেতে চেয়েছে সকল কিছু যা সাধারনের কাছে অভাবনীয়।
শেষ জীবনে স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছেন কপর্দক পরিণতি। দ্বিতীয় স্ত্রী’র অকাল মৃত্যু। ফিরে তাকাননি প্রথম স্ত্রী ও মৃত সন্তানদের দিকেও।
নিজের জীবন নিয়ে কবি যথার্থই বলে গিয়েছিলেন-"আমি এক সকালে উঠে নিজেকে সফল হিসেবে পাইনি, এই কাব্যের সফলতা বহু বছরের কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।"
অনেকদূর পথ হাঁটার পর আপনি ক্লান্ত হলেন। একটু জল খুঁজছেন। যদিও কথা দিয়েছেন নিজেকে, তাঁকে না খুঁজে পাওয়া অবধি থামাবেন না পা।এই জল আর সেই তাঁকে খুঁজে পাওয়ার ব্যবধানেই মহাকবির জন্ম।
মহাকবির কাছে ১৯৬ তম জন্ম বার্ষিকীতে আবদার আবারও এই বঙ্গেই ফিরে আসার।