নজরুল তখন থাকেন কৃষ্ণনগরের স্টেশন রোডে, 'গ্রেস কটেজ' নামের বাড়িটি ভাড়া নিয়ে। সেটা ১৯২৬ সাল। এ বছরই ৯ অক্টোবর এই বাড়িতেই জন্ম হয় নজরুলের প্রথম পুত্র বুলবুলের। এখানেই পরের বছর ১৩ মার্চ তার মুখেভাত হয়। কবি তার নাম দেন, অরিন্দম খালিদ।
বুলবুল দীর্ঘ জীবন নিয়ে আসেনি। তাই সে হয়তো প্রিয় হয়ে ওঠার সমস্ত গুণ নিয়েই জন্মেছিল। নজরুলের সে এমন ন্যাওটা হয়ে উঠেছিল যে, তাঁর মতো বাউন্ডুলে মানুষকেও সে বেঁধে ফেলেছিল ঘরে। পাঁচ বছর বয়সেই সে হয়ে উঠেছিল রাগ সঙ্গীতের পাক্কা সমঝদার। এই বয়সেই সে স্বর শুনে রাগ চিনতে পারত, গাইতে পারত মিষ্টি সুরে। গান পাগল নজরুল তাকে নিয়ে যেতেন সঙ্গে করে গানের মজলিশে; আর সে ফিরে এসে নজরুলের কোলে বসে সেইসব গান অবিকল গেয়ে উঠতে পারত। এমনি ছিল তার স্মৃতিশক্তি, এমনি ছিল তার আজন্ম প্রতিভা। সে ছিল নজরুলের প্রিয়তম পুত্র, চোখের মণি। তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন, তাঁর এ ছেলে একদিন দেশের গুণী সঙ্গীতশিল্পীদের একজন হবে, খুব বড় হবে, খুব। আসলে আঘাত পাবার সময় ঘনিয়ে আসছিল, বুঝি এত মায়া, তাই এত স্বপ্ন!
১৯৩০ সালের মে মাস। কবি তখন কৃষ্ণনগরের বাস উঠিয়ে সপরিবারে কলকাতায়। কবির দ্বিতীয় পুত্র সব্যসাচীর সবে একবছর বয়স। তখন বুলবুলের বসন্ত হল। গুটিবসন্ত। বসন্ত ছড়াল চোখে। চোখ নষ্ট হওয়ার জোগাড় হল। দুর্বিষহ এই রোগযন্ত্রনায় বাবাকে একটুও কাছছাড়া করতে চায়নি বুলবুল। তাই চোখের সামনে তার মৃত্যু অসহায়ভাবে দেখতে হয়েছিল নজরুলকে। এই শোক ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় শোক। সাহিত্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে ভুলতে চাইলেন, লিখতে লাগলেন হাস্যরসে মোড়া 'চন্দ্রবিন্দু' কাব্যের কবিতাগুলো। কিন্তু, ভুলব বললেই কি আর এই শোক ভোলা যায়! সমস্ত সত্তা যে চাইছে প্রিয়তম পুত্রটিকে আর একবার চোখের দেখা দেখতে। আহা, এমন যদি হত কোন অলৌকিক ক্ষমতার বলে মৃতেরা আবার কবর থেকে বেঁচে উঠত! তাহলে তো আর চিরজনমের মতো প্রিয়তম সন্তানটি তাঁকে হারাতে হত না! এই আর্তি নিয়েই নজরুল ছুটলেন অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, এমন অলৌকিকতার সন্ধানে। সেই পথে যদি আবার পুত্রের সঙ্গে দেখা করা যায়, যদি একবার তাকে ছোঁয়া যায়! তিনি শরণ নিলেন যোগীবর বরদাচরণের। শুরু করলেন যোগসাধনা। শাস্ত্রপাঠ। শোনা যায়, একবার নাকি ছেলেকে চাক্ষুষ দেখার বিভ্রম তাঁর হয়েছিল। কিন্তু, সেই দেখাতে পাওয়া হয়নি ছেলেকে, শান্তি আসেনি মনে। মানসিক এই অশান্তির সঙ্গে অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই মিশে গিয়েছিল হঠাৎ স্ত্রীর পঙ্গু হয়ে যাওয়ার বেদনা। আর এইসব মিলিয়েই দিলখোলা কবি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়েছিলেন নির্বাক অসুস্থতার দিকে।