ঘরে-বাইরে নির্যাতন ঘুণপোকার মত কুরে খায় মেয়েদের মনকে

সময়টা ১৯৬০ সাল। ২৫শে নভেম্বর। লাতিন আমেরিকার দেশ ডোমিনিকান রিপাবলিকের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে চলছিল আন্দোলন। সেই শাসক মেয়েদের মানুষ বলে মনে করতেন না। মেয়েদের কাজ শুধুই সন্তান প্রতিপালন ও সংসার সামলানো। সেটাও আবার পুরুষের বলে দেওয়া পথে। মেয়েদের ইচ্ছেমত বাঁচার চেষ্টাকে তাদের ধৃষ্টতা বলে মনে করতেন সেই স্বৈরাচারী শাসক। এমনকি মেয়েদের পড়াশোনার অধিকার আছে বলেও তিনি মনে করতেন না।

এই শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন বেশ কিছু সাহসী মহিলা। প্রতিদিন এই আন্দোলনে যোগ হচ্ছিল নতুন নতুন নারী-মুখ। যথারীতি রাজার ঘরে ভাঙনের আভাস পাওয়া যেতে শুরু করে। স্বৈরাচারী শাসকের মনের ভেতর তখন ভয় বাসা বেঁধেছে। এতদিন যে সব মহিলাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে হেলায় উপেক্ষা করেছেন তাঁদের এক জোট হওয়ায় সেই শাসকের সিংহাসন টলমল করতে শুরু করে দিয়েছে। মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন সেই শাসক। শুরু হয় মেয়েদের উপর অত্যাচার। হিংস্রতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এই অত্যাচারের ফলে একসঙ্গে মারা যায় একটি পরিবারের তিন মেয়ে। প্যাট্রিয়া, মারিয়া তেরেসা, ও মিনার্ভা মিরাবেল। তিন বোন। তাঁদের হত্যা করেছিলেন সেই শাসক। এরপর সারা বিশ্ব জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

পদচ্যুত হয় সেই শাসক। মহিলারা যে অবহেলার পাত্রী নন মানতে বাধ্য হয় সারা বিশ্ব। এই আন্দোলন সেই সময় বিশ্বের মহিলাদের লড়াইয়ের একটা পথ খুলে দেয়। তাদের লড়াইকে সারা বিশ্ব কুর্নিশ করতে থাকে। 

১৯৮১ সাল থেকে ২৫ শে নভেম্বর দিনটিকে এই তিন বোনের স্মরণে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

নারীর প্রতি যে কোনও ধরনের হিংসামূলক ব্যবহার রোধ করা এই দিবস পালনের মূল লক্ষ্য। সমগ্র বিশ্বে এই দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে পালিত হয়। ভারতেও মহিলা ও শিশু বিষয়ের মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবছর ২৫ শে নভেম্বর থেকে ১০ই ডিসেম্বর পর্যন্ত নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষকাল উদযাপন করা হয়। আর নভেম্বরের ২৫শে পালিত হয় নির্যাতন-বিরোধী দিবস।

বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও এই উদযাপনে সামিল হয়।

কিন্তু এ তো গেল পটভূমিকা। বাস্তব পরিস্থিতি কী? এই দিবস পালন কি নারী নির্যাতনকে সমাজ থেকে দূরে সরাতে পেরেছে?

সমীক্ষা বলছে, সারা বিশ্বজুড়ে আজও প্রতি ১০০ জন মহিলাদের মধ্যে সাত জন নির্যাতিতা হন। সেটা তো শুধুই যৌন নির্যাতন এমন নয়। সেখানে রয়েছে মানসিক নির্যাতন ও।

সমীক্ষা আরও বলছে শারীরিক নির্যাতন তবুও মানুষের গোচরে আসে। কিন্তু যে নির্যাতন ঘুণপোকার মত কুরে কুরে খায় মেয়েদের মনকে, তা হল মানসিক নির্যাতন। বহুস্তরীয় সমাজে মানসিক নির্যাতন নানা দিক থেকে সমস্যা সৃষ্টি করে।

বুড়ি রোজ সকালে উঠে খানিকটা সময় একা ঘরে নিজেকে বন্দী রাখে। এই সময়টায় ঝরঝর করে কাঁদে ও। ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করে গত রাতের সমস্ত কষ্ট। আসলে কাউকে বলার উপায় নেই যে প্রতি রাতে স্বামীর কাছে অত্যাচারিত হয় ও। বললেও কেউ হয়তো বিশ্বাস করবে না। কেউ বা বলবে মানিয়ে নেওয়াটাই ধর্ম। তাই নিজের সঙ্গে কাটানো এই একটা ঘন্টায় ও লড়াই করে এই যন্ত্রণার সঙ্গে।

নামটা কাল্পনিক হলেও এই ঘটনাটা একেবারেই বাস্তব।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন মেয়েদের অনেক অত্যাচার আজও শুকনো নালার মত বয়ে চলেছে তার কারণ তাদের অত্যাচারের কথা শোনার কেউ নেই। বিবাহের পরে অত্যাচারের শিকার হলে বাপের বাড়ির লোক বলে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। শ্বশুরবাড়িতেও শোনার কেউ নেই। তাই দিকে দিকে বুড়িদের সংখ্যা বাড়ে। যদিও ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো বলছে নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে তার একটা বড় কারণ আগে অত্যাচারের ঘটনা কেউ জানতেই পারত না। কিন্তু এখন মেয়েরা সাহসী হওয়ার চেষ্টা করছে। নিজেদের অসহায়তার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে নিজেদের অত্যাচারের কথা আইনের মাধ্যমে জানাচ্ছে।

নারী নির্যাতন বিরোধী পক্ষকালে যে সমস্ত কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয় সেই সব কর্মসূচির বেশিরভাগ কর্মকর্তাদের বক্তব্য থাকে এটাই অত্যাচার মেনে না নিয়ে প্রতিবাদ জানানো উচিত। প্রয়োজনে আইনের সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবা উচিত।

অত্যাচার‌ আসলে আগুনের শিখার মত। দগ্ধ করাই তার কাজ। সমাজকর্মীরা বলছেন, করোনাকালে নারী নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে। কিন্তু আশার কথা সেই সব তথ্য পুলিশের কাছে আসছে। 

সারা বিশ্ব জুড়ে এই বছরের ২৫ নভেম্বরও নারী নির্যাতন বিরোধী দিবস হিসেবে নির্ধারিত। কিন্তু কেবলমাত্র একটি দিন নয়, প্রতিদিনের আলো খোঁজার লড়াই চলুক, নির্যাতন-মুক্ত সমাজে নারী স্বাধীনতা থাকুক স্বতঃস্ফূর্ত, এমনটাই কাম্য।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...