এই পৃথিবী বিস্ময়ের এক আধার। বিস্ময় মানেই অজানা, অচেনা। যুগে যুগে মানুষ অজানাকে জানতে চেয়েছে, অচেনাকে চিনতে চেয়েছে। অধরাকে ধরার অদম্য চেষ্টায়, দুর্গমকে জয় করেছে। বারবার দুঃসাহসী অভিযানে বেরিয়েছে। মানুষ অসম সাহসের নিদর্শন রেখে গিয়েছে। দুর্গম অভিযানে বার হয়ে বহু মানুষকে আত্মাহুতি দিয়েছেন।
কিন্তু অভিযান থামেনি। একদিন না একদিন সে জয় করেছে সব অজেয়কে। ভয়কে জয় করেই তো জয়ী হওয়া যায়। এমনই এক জয়ীর মৃত্যু দিন আজ। তাঁর চোখে ছিল অধরাকে ধরার অদম্য স্বপ্ন। সাহস, ইচ্ছাশক্তি আর জয় করার নেশাকে সম্বল করে তিনি অনন্য নজির গড়েছেন।
তিনি এডমন্ড হিলারি, আজ থেকে এক শতাব্দী আগে ২০শে জুলাই ১৯১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে হিলারির জন্ম হয়েছিল। তাঁর বাবা ছিলেন পার্সিভাল হিলারি এবং মা গারট্রুডো ক্লার্ক। হিলারিরা জাতিতে ছিলেন ইংরেজ। উনবিংশ শতকে ইয়র্ক্শায়ার থেকে এসে তারা নিউজিল্যান্ডের ওয়াইরোয়া নদীর তীরে থাকতে শুরু করে। পার্সিভাল গ্যালিপলির যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধে যোগদানের সম্মানিকস্বরূপ তাদের পরিবারকে থাকার জন্য টুয়াকাউ অঞ্চলে জমি দেওয়া হয়েছিল। সেখানেই তারা এপিয়ারী তৈরি করেন। মৌমাছি প্রতিপালন করে উৎপন্ন মধু বিক্রি করে তাদের সংসার চলত। এই মৌমাছির ফার্মেই এডমন্ড হিলারির জন্মে হয়েছিলেন। ছোটবেলায় মৌমাছিদের নিয়ে খেলতে ভালবাসতেন হিলারি। টুয়াকাউ নার্সারি স্কুলে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল।
১৬ বছর বয়সে স্কুল জীবনের একটি ঘটনা হিলারির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। স্কুল থেকে তাদের ৯০০০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মাউন্ট রুয়াপেহুতে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে গিয়েই হিলারির অমূল পরিবর্তন হল। জীবনকে অন্য এক আঙ্গিকে দেখতে শুরু করলেন তিনি। সেদিন থেকে পাহাড়ের নেশায় জড়িয়ে পড়লেন হিলারি। এই ১৬ বছর বয়সের আগে পর্যন্ত সে'ভাবে বাড়ির পা রাখেনি হিলারি।
১৯৩৫ সালে ১৬ বছর বয়সে প্রথম পর্বত দেখেন হিলারি। আদপে মাউন্ট রুয়াপেহু ছিল একটা মৃত আগ্নেয়গিরি। সেখানেই পর্বতের ঢালে স্কী খেলে নেমেছিলেন হিলারি।
সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা কোনদিনও ভুলতে পারেননি হিলারি। কদিন পর এডমন্ড হিলারির ফের রুয়াপেহু পর্বতে গেলেন। এরপর থেকেই পর্বত এডমন্ড হিলারির মনে নেশার মতো জাঁকিয়ে বসে। কয়েক বছর পর এডমন্ড হিলারির এক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ১২ হাজার ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট কুক পর্বতে আরোহণ করেন। পার্বত আরোহণে এই সাফল্য হিলারির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ৬ ফুট দুই ইঞ্চির ঋজু শরীর, পর্বত আরোহণে তাকে সাহায্য করেছিল। স্কুলের পাঠ চুকিয়ে অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্ক ও বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি হলেন হিলারি। তিনি ট্রাম্পিং ক্লাবের সদস্য হলেন।
১৯৩৯ সাল নাগাদ সুযোগও চলে এল, দক্ষিণ আল্পস পর্বতমালার মাউন্ট অলিভিয়া জয় করলেন হিলারি। এটাই হিলারির জীবনের প্রথম শৃঙ্গ জয়।
সংসার চালাতে পড়াশোনায় ইতি টেনে হিলারি যোগ দিলেন পৈতৃক ব্যবসায়। বাবা ও দাদাদের সঙ্গে সারা গরমকালে জমিয়ে ব্যবসা করতেন আর শীত পড়লেই টাকা জমিয়ে ছুটতেন পাহাড়ে। এডমন্ড হিলারির পর্বত আরোহণের নেশা চেপে বসল। তারপর থেকে প্রত্যেক সাপ্তাহিক ছুটিতেই এডমন্ড হিলারি পাহাড়ে ছুটতেন। শুরু হল পর্বতারোহণের খেলা। কয়েক মাসের মধ্যেই হিলারি নিউজিল্যান্ডের সব পর্বত জয় করে ফেলেছিলেন।
এরপর শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিলারি রয়েল নিউজিল্যান্ড বিমানবাহিনীতে সি প্লেনের নেভিগেটার হিসেবে যোগদান করলেন। এডমন্ড হিলারির পোষ্টিং হয় নিউপ্লিমাউথে। সেখানকার বিমানঘাঁটির পাশে মাউন্ট ইগমন্ট নামে একটা পর্বত ছিল। এডমন্ড হিলারির পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করলেন।
১৯৪৫ সালে তাকে ফিজি এবং সলোমান দ্বীপপুঞ্জে পাঠানো হল। সেখানে এক দুর্ঘটনায় বিভৎসভাবে আগুনে ঝলসে গিয়েছিলেন হিলারি। ফের সুস্থ হয়ে ছুটলেন পাহাড়ের টানে। ততদিনে যুদ্ধ থেমে গিয়েছে। ১৯৪৮ সালে জয় করলেন নিউজিল্যান্ডের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট কুক। ১৯৪৯ সালে তিব্বতের ভিতর দিয়ে এভারেস্ট অভিযান বন্ধ হল। এভারেস্ট তখন অধরা বিস্ময়। নেপাল ছাড়া এভারেস্ট যাওয়ার আর কোনো পথ নেই। কিন্তু অনুমতি আদায় এক দুরহ ব্যাপার।
ইতিমধ্যেই ১৯৫০ সালে হিলারি ইংল্যান্ড থেকে পর্বতারোহণ সম্বন্ধে উচ্চতর কঠিন প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেলেছিলেন। কেবল প্রশিক্ষণ নয়, পর্বতারোহণের উপর যতো বই ছিল সব একে একে পড়ে ফেললেন। পড়তে পড়তেই বিশ্বের বৃহত্তম ও সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিমালয় পর্বতশৃঙ্গ সম্পর্কেও এডমন্ড হিলারির জেনে ফেলেছিলেন। সেদিন থেকেই হিলারির মনে জাঁকিয়ে বসে এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন।
পর্বতারোহণে হ্যারি আইরশ নামে এক শিক্ষাগুরু পেয়েছিলেন। এরপর এডমন্ড হিলারির আরেকজন খ্যাতনামা পর্বতারোহী সঙ্গী জুটে যায়; তার নাম জর্জ লোয়। এই জজ লোয়ের সাথে পর্বতারোহণ করার সময়, তাদের মনে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন জাগে।
১৯৫২ সালে এক সুইস অভিযাত্রী দল এভারেস্ট অভিযানে গিয়ে বিফল হন। খারাপ আবহাওয়ার দরুন লক্ষ্যের মাত্র ৮০০ ফুট দূর থেকে ফিরে আসতে হয় তাদের। এর আগেও ১৯২২ , ১৯২৪ , ১৯৩৬ এবং ১৯৩৮ সালে একাধিকবার এভারেস্ট অভিযান হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারেই ব্যর্থতা এসেছে।
১৯৫৩ সালে আরেক ব্রিটিশ অভিযাত্রীর দল মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানে বের হল। ব্রিটিশ পর্বতারোহীদের মধ্যে এরিক শিপটন হিলারির পরিচিত ছিলেন। সেই সুবাদে অভিযাত্রী দলের সদস্য হিসাবে নাম লেখালেন হিলারি ও জর্জ লোয়ে নাম। সেই দলে হিলারি এবং তেনজিং নোরগে স্থান পেলেন, দলনেতা হল জন হান্ট।
১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে বেস ক্যাম্প থেকে ২০ জন শেরপা, ৩৬২জন কুলি এবং দশ হাজার পাউন্ড মালপত্র নিয়ে প্রায় চারশতাধিক অভিযাত্রী এভারেস্ট অভিযানে রওনা দিলেন। আগের বছর সুইস অভিযাত্রীরা সাউথ কল আবিষ্কার করেছিলেন, সেখানেই ক্যাম্প ফেললেন হিলারিরা। সেদিন মাউন্ট এভারেস্টের অপূর্ব রূপ দেখেছিলেন হিলারি। যা তিনি বারবার তার নানান ইন্টারভিউতে বলে গিয়েছেন। প্রতিকূল আবহাওয়া, পদে পদে মৃত্যু ভয়, অন্যদিকে সৌন্দর্য! এভারেস্ট কে কী উপেক্ষা করা যায়। ২৬শে মে টম বুর্দিল ও চার্লস ইভান্স প্রথম বেরোলে, ভাবলেন এভারেস্টে জয় করবেন।
কিন্তু ইভান্সের অক্সিজেন সিলিন্ডারে গন্ডগোল দেখা গেল। শৃঙ্গ জয়ের ৩০০ ফুট নীচ থেকে তারা ফিরে আসলেন। তুমুল তুষার ঝড়ে দুদিন নষ্ট হয়ে গেল। এবার হিলরি আর নোরগের পালা। ২৮ শে মে ৮৫০০ ফুট উঁচুতে তাঁবু ফেলা হল। সেখানে হিলারি আর নোরগেকে রেখে নেমে এলেন জর্জ, আং নিমা, আলফ্রেড গ্রেগরিরা।
সে রাত কাটল। কিন্তু সারারাত বরফ পড়ে তাদের জুতো জমে গেল। দুঘন্টার চেষ্টায় জুতো সরিয়ে পথ চলতে শুরু করলেন তারা। হিলারি একটা ফাটল দেখলেন, নিজেই আগে পা ফেলেন। শেরপা নোরগেকে বললেন অনুসরণ করতে। ঠান্ডায় জমে যাওয়া অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন নিতে কষ্ট হচ্ছিল তাদের, কিন্তু ভয়কে তারা মিতে বানালেন।
১৯৫৩-এর ২৯শে মে সকাল ১১:৩০ নাগাদ এডমন্ড হিলারি, নেপালী পর্বতারোহী শেরপা তেনজিং নোরগের সঙ্গে এভারেস্ট পর্বত শৃঙ্গ জয় করলেন। প্রথমবারের মানুষের পা পড়ল পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গে, লেখা হল ইতিহাস। হাতের আইসস্কি তুলে ছবি তুললেন তারা। মানুষের অসাধ্য সাধনের ইতিহাসে দুজনের নাম লেখা হয়ে গেল।
হিলারি বিশ্বের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিযাত্রী। এডমন্ড হিলারি সর্বপ্রথম এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করেন, তাছাড়াও হিলারি আরও কয়েকটি দুঃসাহসিক অভিযানে অংশ নিয়ে সাফল্য অর্জন করেছিলেন। এডমন্ড হিলারির সর্বপ্রথম আন্টার্কটিকা মহাদেশের উত্তর-দক্ষিণ থেকে শুরু করে মেরুবিন্দু পার হয়ে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হল দুটো বিশ্ব রেকর্ডের অধিকারী হিলারি ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত দেশের বাইরেই কখনও পা রাখেননি। তার আগে কখনও পর্বত চোখেও দেখেননি।
এভারেস্ট জয়ের পরে হিলারি স্যার উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। হিলারি একাধিক বইও লিখেছেন। ভারত ও বাংলাদেশে নিউজিল্যান্ডের হাইকমিশনার পদে আসীন ছিলেন হিলারি। আজকের দিনে অর্থাৎ ১১ই জানুয়ারি ২০০৮ সালে তিনি পরলোক গমন করেন।
এর পরেও একাধিকবার এভারেস্টে উঠেছে মানুষ, আজও প্রতিবছর এভারেস্ট অভিযান হয়। কিন্তু হিলারিই প্রথমবারের জন্যে অজানা এভারেস্টেকে ছুঁয়ে দেখেছিলেন। তাই ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। যতদিন অপরূপ রূপ নিয়ে মাউন্ট এভারেস্টে দাঁড়িয়ে থাকবে, ততদিন এডমন্ড হিলারি বেঁচে থাকবেন।