অভিশপ্ত ফ্যারাও তুতেনখামুন
ইতিহাসের পাতায় নাম তোলা তো হল। তবুও নাম কাটা গেল জীবনের তালিকা থেকে।
না। নাম বাদ পড়েনি ফ্যারাওয়ের। তিনি তো মরেই অমর।তাঁর মমিতে।আজও।শুধু মুদির খাতায় নাম কাটা যাওয়ার মত বাদ পড়লেন সেই মমির আবিস্কারক দল।
যাদের নাটের গুরু হাওয়ার্ড কার্টার।
মিশরীয় ইতিহাসের বালক সম্রাট।রাজকীয় গুনে বিশেষ স্বীকৃতি না পেলেও মৃত্যুর পরপারে গিয়ে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন বহু আবিস্কারকের রাতের স্বপ্ন।সবথেকে চর্চিত ফ্যারাও, তুতেনখামুন।
মিশরীয় স্থাপত্য বিশেষত বিভিন্ন সম্রাট-সম্রাজ্ঞীর সমাধি বরাবরিই রহস্যের কেন্দ্রে থেকে এসেছে। অন্যান্য রাজা ও রানীর মমির ঠিকানা পেলেও বহুদিন রহস্যের অন্ধকারের এক কোনে থেকে গিয়েছিলেন ফ্যারাও তুতেনখামুন।
১৯২২। ততদিনে ভ্যালি অফ দ্য কিং অঞ্চলের মাটি ছুঁয়ে গিয়েছেন অগুনতি অনুসন্ধানকারী। তবে ফেরার পথের পায়ের ছাপ কেউ রেখে যেতে পারেননি। রহস্যের গোলক ধাঁধা শুষে নিয়েছে সকলকেই।
১৮৯১ সালের কথা। হাওয়ার্ড কার্টার নামের একজন অল্পবয়স্ক ইংরাজ প্রত্নতত্ত্ববিদ মিশরে এলেন। মিশরের প্রাচীন স্থাপনা নিয়ে তার প্রচন্ড আগ্রহ!
ছয় বছরের টানা পরিশ্রমে একে একে বহু রহস্যের উদ্ঘাটক তিনি । তবুও গবেষণা বলছে আড়ালে থেকে গিয়েছেন একজন।ফ্যারাওদের মধ্যে একেবারেই অপরিচিত রাজা তুতেনখামুনের।
ইতিহাসের কোথাও এটা খুঁজে পাওয়া যায়নি যে, কীভাবে তুতেন খামেনের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগ গবেষকেরই ধারণা, তাকে হত্যা করা হয়েছে।
হাওয়ার্ড কার্টার তার অনুসন্ধিৎসা কে লক্ষ্যে পরিণত করলেন। শরণাপন্ন হলেন লর্ড কার্নার্বন নামক একজন ধনকুবেরের। তিনিই যোগাবেন অভিযানের যাবতীয় খরচ।
পরবর্তী পাঁচ বছরে অদম্য হাওয়ার্ড তার অভিযানের দল নিয়ে সম্পূর্ণ কিং ভ্যালী চষে ফেললেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না। মনে হল এই পাঁচ বছরের সঞ্চয় বলতে শুধু সময় অপচয়।
ওইদিকে লর্ড কার্নার্বন হাওয়ার্ডকে ইংল্যান্ডে ডেকে পাঠান। এই ব্যর্থ অভিযানের খরচ আর তিনি বহন করবেন না। পাঁচ বছরের সমস্ত কষ্ট বৃথা যাবে? হাওয়ার্ড শেষ আরও একবারের জন্যে করজোড়ে রাজি করালেন লর্ড কে।
আবার মিশরে ফেরা।এবারে ১৯২২। মিশরে আসার সময় হাওয়ার্ড কার্টার সঙ্গে করে একটি হলুদ ক্যানারি পাখি নিয়ে আসেন। গুপ্তচর পাখি। হাওয়ার্ডের দলের সুপারভাইজার একারণেই তাকে বলেছিল গোল্ডেন বার্ড।
হ্যাঁ গোল্ডেন বার্ড আর বলতে!
১৯২২ এর ৪ নভেম্বর। সেই ঐতিহাসিক দিন। হাওয়ার্ডের কর্মচারীরা তুতেনখামুনের সমাধির প্রবেশপথে প্রথম হোঁচট খেল। তারা পৌঁছে গিয়েছে সম্রাট রামেসিস চতুর্থ- এর সমাধিতে।ততক্ষণে প্রায় দুই লক্ষ টন ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করা হল।
নিচে পাথর কেটে তৈরী করা একটি সিঁড়ির সন্ধান পেলেন। খুঁড়তে খুঁড়তে একই রকম আরও প্রায় পনেরো টি সিঁড়ি অতিক্রম করে অবশেষে একটি প্রাচীন এবং সীল করা দরজার সামনে এসে উপস্থিত হলেন।
দরজার উপর হায়ারোগ্লিফিকে বড় করে লিখা ছিল তুতেনখামুন। এই দরজাটি অতিক্রম করলে ভেতরে ঠিক একই রকম আরও একটি দরজা । তারপর আরও একটি।
অবশেষে সেটি অতিক্রম করলেই দেখা মেলে তার।সম্রাট তুতেনখামুন।
ঠিক সেদিন রাতেই হাওয়ার্ড কার্টার বাড়িতে ফিরে খবর পেলেন তার আদরের পাখি আর নেই। একটি কোবরা তার ক্যানারি পাখিটিকে খেয়ে ফেলেছে।
হাওয়ার্ড কুসংস্কারকে মোটেই বিশ্বাস করতেন না। তাও পরিচারিকার কথায় ফ্যারাও এর অভিশাপেই নাকি তার পাখির এই দশা। কারণ সে-ই না খুঁজে পাওয়া পথের সন্ধান দেয়।
পাঠক অবাক হতে পারেন শুনে যে ফ্যারাওদের সুরক্ষার প্রতীক হচ্ছে কোবরা এবং শকুন। তুতেনখামুনের বর্মটির উপর তাকালেই দেখবেন মাথার উপর একটি কোবরার প্রতিকৃতি।
আর দেরি না করেই লর্ড কার্নার্বনের কাছে একটি টেলিগ্রামে তাকে তার আবিষ্কার নিজের চোখে দেখার জন্য মিশরে আসতে অনুরোধ করেন হাওয়ার্ড। লর্ড কার্নার্বনকে তার বন্ধু জ্যোতিষী মিশর যেতে বারণ করে।
কারণ তিনি দুর্ঘটনাক্রমে জানতে পারেন যে, লর্ড কার্নার্বন তুতেনখামুনের সমাধিতে আঘাত পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বেন, যা কখনও সেরে উঠবে না এবং মিশরেই তিনি মৃত্যুবরণ করবেন।
পাঁচ পাঁচটি বছর কোনও প্রাপ্তির আশা না করেই তুতেনখামুনের সমাধি খোঁজায় অর্থ ঢাললেন যিনি, তার আগ্রহকে দমিয়ে রাখে ভাগ্যের লিখন? তাই লর্ড কার্নার্বন সমস্ত বাধা অতিক্রম করে মিশরে এসে পৌঁছলেন।
৩০০০ বছরের ইতিহাস কে উপেক্ষা করে এই প্রথম কেউ সমাধিটিতে হস্তক্ষেপ করল।
বেশিদিন বাঁচেননি তিনিও। গালে একটি মশার কামড়ের জন্য তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেভ করার সময় মশার কামড়ের স্থানটা কেটে যায় এবং ইনফেকশন হয়ে একসময় নিউমোনিয়ার রূপ নেয়। সমাধি উন্মোচিত করার মাত্র সাত সপ্তাহের মাঝেই লর্ড কার্নার্বন প্রচণ্ড ত্যাগ করলেন ইহলোক।
খুবই রহস্যজনকভাবে ঐ রাতেই হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা তার পোষা কুকুরটি অদৃশ্য কোনও কিছুর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড গর্জন করতে থাকে। রক্ত হিম করা ভৌতিক শব্দে আর্তনাদ করতে করতে এভাবেই একসময় মারা যায়।কুকুরটিও সেই সময় উপস্থিত ছিল বই-কী!
আগামী সাত থেকে আট বছরের মধ্যে মৃত্যু আগলে নিতে থাকে অভিযানের সঙ্গে যুক্ত প্রায় সকলকেই।প্রত্যেকেই অস্বাভাবিকভাবেই মৃত্যু মুখে পতিত হন।যদিও কার্টারের মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক।
যা ঘটে তার কিছু তো বটেই- এই প্রবাদ কে তবে আখেরেই উপেক্ষা করা যায় না। তবুও সাহস আগলে রেখে এগিয়ে যেতে হয় সকলকে। আজানাকে জানার সাধ যে মানুষকে বড়ই তাড়া করে।