ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের জটিল ভূতত্ত্বের বিবর্তনের কাজে গিয়ে বিজ্ঞানীরা যার হদিস পেলেন তা গবেষণার আর এক দিক উন্মচন করলো - পাওয়া গেলো পৃথিবীর বুকে লুকোনো আস্ত একটা মহাদেশের - নাম ‘গ্রেটার এড্রিয়া’ - কিন্তু এই নাম কেন? কারণ হিসেবে নেদারল্যান্ডসের উট্রেখ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ্লোবাল টেকটনিক্স ও প্যালিয়োজিয়োগ্রাফি’-র অধ্যাপক এবং গবেষক ডো ভ্যান হিন্সবের্গেনের মতো বিজ্ঞানীর মতে, যে সব পর্বতমালা নিয়ে কাজ হচ্ছে সেগুলির বেশির ভাগই গ্রেটার এড্রিয়া থেকে উদ্ভূত। মহাদেশটি উত্তর আফ্রিকা থেকে ২০ কোটি বছরেরও বেশি সময় আগে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। গবেষকদের মতে , ওই মহাদেশটির যেটুকু অংশ আছে, সেটি টুরিন থেকে শুরু করে এড্রিয়াটিক সাগর হয়ে মিশে গিয়েছে ইটালির তলদেশে। এই জায়গাটিকে ভূতত্ত্ববিদেরা বলেন এড্রিয়া। তাই এই গবেষণায় যুক্ত বিজ্ঞানীরা অতীতে অনাবিষ্কৃত মহাদেশটির নাম দিয়েছেন, গ্রেটার এড্রিয়া।
আরো স্পষ্ট করে বলতে হলে এর বিস্তৃতি স্পেন থেকে ইরানের মধ্যে পর্বতশিখর থেকে সমুদ্রের তলদেশ পর্যন্ত। আয়তনে গ্রিনল্যান্ডের সমান। অন্তত ২০ কোটি বছর আগে উত্তর আফ্রিকা থেকে ভেঙে তৈরি হয়েছিল এই মহাদেশ। পরে তা মিশে গিয়েছিল দক্ষিণ ইউরোপের নীচে।
নেদারল্যান্ডসের উট্রেখ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ্লোবাল টেকটনিক্স ও প্যালিয়োজিয়োগ্রাফি’-র অধ্যাপক এবং গবেষক ডো ভ্যান হিন্সবের্গেন জানান, এ মাসে ‘গন্ডোয়ানা রিসার্চ’ জার্নালে হিন্সবের্গেনদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। পর্বত শিখরের বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে মহাদেশগুলির বিবর্তনও বোঝা যায় এই গবেষণায়।
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ভূতত্ত্ববিদেরা ‘প্লেট টেকটনিক’ এর সংজ্ঞা দেন কিছুটা অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এমনিতে ‘প্লেট টেকটনিক’ বলতে বোঝায় - কী ভাবে মহাসাগর এবং মহাদেশ গড়ে উঠেছিল। আর এই তত্ত্বানুযায়ী, পৃথিবীর অন্যান্য অংশে প্লেটগুলি একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা না খেয়ে পাশাপাশি চলতে থাকলে তারা অবিকৃতই থাকে। কিন্তু তুরস্ক এবং ভূমধ্যসাগরের ক্ষেত্রে বিষয়টা একেবারেই আলাদা। হিন্সবের্গেনের মতে এটা এক রকমের ভূতাত্ত্বিক চলন। এর সঙ্গে তুলনা করলে হিমালয় পর্বতমালা কিন্তু অনেক সহজ বিষয়।
বিজ্ঞানীদের তত্ত্বানুযায়ী গ্রেটার এড্রিয়ার সিংহভাগ আছে জলের তলায়। অগভীর সমুদ্র, প্রবাল প্রাচীর আর স্তরীভূত পাথুরে অংশে ঢাকা। গ্রেটার এড্রিয়া যখন দক্ষিণ ইউরোপের তলদেশে মিশে গিয়েছিল, তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া স্তূপীকৃত প্রস্তর সমন্বয় থেকে পর্বতমালার সৃষ্টি হয়। যেগুলি খুঁজে পাওয়া যায়, আল্পস, অ্যাপেনাইনস পাবর্ত্য এলাকা, বল্কান উপদ্বীপ, গ্রিস এবং তুরস্কে।
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে পর্বতমালার বিবর্তন ফিরে দেখার কাজটি শুরু হয়েছে সম্মিলিত ভাবে যাতে ৩০টিরও বেশি দেশ অংশ গ্রহণ করছে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, প্রত্যেকটির ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা, মানচিত্র, কী ভাবে সব কিছুর বিবর্তন হলো, তার সম্যক ধারণা— এই গবেষণার কাজে অগ্রণী হয়েছে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনানুযায়ী প্লেট টেকটনিক পুনর্নির্মাণ সফটওয়্যার ব্যবহার করে গবেষকেরা একের পর এক স্তর ক্রমাগত পুনর্নির্মাণ করছেন যাতে জানা যায় এ মহাদেশগুলি অনেকটাই আলাদা রকমের দেখতে ছিল।
তবে এই প্রথম নতুন কোনো মহাদেশের সন্ধান পাওয়া গেল, এমন নয়। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসেও গন্ডোয়ানাল্যান্ড থেকে একটি অংশ এ ভাবে ভেঙে গিয়েছিল ২০ কোটি বছর আগে। লাভায় ঢাকা সেই অংশ এখন মরিশাসের তলায়, ভারত মহাসাগরের একটা দ্বীপ। ওই বছরই আর একটি বিজ্ঞানীদল দক্ষিণ প্রশান্তমহাসাগর নিরীক্ষণ করে বার করেছিলেন হারিয়ে যাওয়া মহাদেশ জিল্যান্ডিয়া। তাই বিজ্ঞানের জয়যাত্রা চলতে থাকুক তাতে না হয় প্রতিনিয়ত আরো কিছু নতুনের খোঁজ পাওয়া যাবে, জানা যাবে তথ্য।