ভারতের সংবিধান তৈরিতে এই নারীর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য

স্বাধীন ভারতের সংবিধান তৈরিতে মোট ১৫জন নারীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পাওয়া যায়। ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি ভারতের সংবিধান গৃহীত হলে ভারতকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র রূপে ঘোষণা করা হয়।

স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত শাসনের জন্য প্রয়োজনীয় আইনের নীতি ও রূপরেখাগুলি সংবিধানে উল্লিখিত থাকে। সংবিধান কার্যকরী হওয়ার দিন থেকে ভারতে ব্রিটিশ রাজশক্তির অবসান হয়। ভারত পায় তার নিজস্ব সংবিধান। যে সংবিধান ভারতকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পথে দিশা দেখানোর জন্য তৈরি হয়েছিল।।

মোট ৩৮৯ জনের কঠিন পরিশ্রমের ফল ছিল এই সংবিধান। সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে মোট ১৫জন মহিলা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

17ina-21

এর মধ্যেই একটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নাম লীলা রায়। লীলা রায় ছিলেন সাংবাদিক। রাজনৈতিক আন্দোলনে তাঁর জড়িয়ে থাকা বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল সেই সময়কার মহিলা বিপ্লবীদের। ১৯২১ সালে তিনি কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন। তিনি পদ্মাবতী স্বর্ণ পদক লাভ করেছিলেন।

সেই সময়টা মেয়েদের জন্য বেশ কঠিন ছিল। মুক্তির আকাশ খুঁজে পাওয়া তাদের জন্য যুদ্ধ সমান ছিল। মেয়েদের উচ্চশিক্ষার অধিকার সেই ভাবে ছিল না।। কিন্তু লীলা রায়ের মেধা ও তাঁর ইচ্ছের বিচার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর হার্টস তাঁকে পড়াশোনার বিশেষ অনুমতি প্রদান করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী মহিলা ছিলেন লীলা রায়।

শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রে নয় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে লীলা রায়ের ভূমিকা বেশ সক্রিয় ছিল। বাংলার অনগ্রসর, অন্ধকারে নিমজ্জিত নারী সমাজকে একটা আলোর পথ দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন লীলা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সময় পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন লীলা সেই সময় মেয়েদের স্নাতকোত্তর পড়ার কোন সুযোগ ছিল না। আসলে মেয়েরা যে এতটা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, তা সেইসময়ের সমাজের ভাবনাতেই ছিল না। ছিল না সহশিক্ষা।

ছক ভেঙেছিলেন লীলা রায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে আবেদন করেছিলেন লীলা। তাঁর জীবনের বাকি পরীক্ষাগুলোর ফলাফলসমেত আবেদন করেছিলেন। প্রথমদিকে চ্যান্সেলর তেমন গুরুত্ব দেননি। কিন্তু লীলার বারবার চেষ্টা চ্যান্সেলেরকে অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য করে। প্রথমবার স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় বসার সুযোগ পান লীলা। বলাই বাহুল্য প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্নেহধন্যা ছিলেন লীলা। নেতাজির অন্তর্ধানের পর তিনি তাঁর তৈরি করা দল ফরওয়ার্ড ব্লকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

লীলা রায়ের পৈতৃক নিবাস বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামে। তাঁরা সে সময় ওই অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক পরিবার হিসেবে গণ্য হতেন।ছোট থেকেই বাবার কর্মসূত্রে নানার জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হতো লীলাকে। লীলার জন্ম ১৯০০ সালের দোসরা অক্টোবর আসামে।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো লীলাকে যন্ত্রনা দিত। লীলা বুঝতে পারতেন পরাধীনতা ভারতকে অনেকটা পিছিয়ে রেখেছে। তাই দেশের স্বাধীনতার জন্য কিছু করার ইচ্ছে ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয় তাঁর মনে। লীলা রায়ের জীবনে তাঁর মা কুঞ্জলতা দেবীর প্রভাব ছিল অসীম।

তাঁর মা গৃহিণী হলেও স্বাধীনতা আন্দোলনকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। ‌ পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে। ছোট লীলাকে মেয়েবেলা থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করার জন্য উৎসাহ জোগাতেন। তবে মেয়েকে তিনি এটাও বুঝিয়েছিলেন সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গেলে সঠিক শিক্ষা বড় জরুরী।

মায়ের শেখানো আদর্শকেই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন লীলা। ১৯১১ সালে ঢাকার ইডেন হাই স্কুলে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন। ১৯১৭ সালে ইডেন হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন লীলা। এরপর তিনি কলকাতায় চলে আসেন উচ্চশিক্ষার জন্য। ভর্তি হন বেথুন কলেজে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য তাঁর লড়াই।

প্রকৃতপক্ষে তার জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিল সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলের ও ভাইস চ্যান্সেলারের সঙ্গে দেখা করে নিজের আবেদন বিশেষভাবে জমা দিয়েছিলেন লীলা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকা অবস্থাতেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও ঋষি রামানন্দের সাহচর্য লাভ করেছিলেন লীলা। ১৯২৩ সালে তিনি ইংরেজিতে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন।

অনেকেই ভেবেছিলেন এত মেধাবী ছাত্রী নিশ্চয়ই পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পথে এগোবেন। শিক্ষাজীবন শেষ করেই লীলা ঝাঁপিয়ে পড়েন নারী শিক্ষার প্রসার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে। নারীদের অশিক্ষার ও অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্য ১২ জন সংগ্রামী নারীকে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন দিপালী সংঘ। মেয়েদের জন্য স্কুল তৈরি করেছিলেন তিনি। তাঁর তৈরি স্কুলের পরবর্তী কালে নামকরণ হয় কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুল।

বিয়ের পর লীলা আবার কলকাতায় চলে যান। কিন্তু সেখানেও আঁকড়ে ধরেছিলেন নিজের কাজকে। মেয়েদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে সচেষ্ট হন। বিপ্লবী পুলিন চন্দ্র দাস এগিয়ে এসেছিলেন লীলাকে সাহায্য করতে। লীলা রায়ের স্কুলে মেয়েদের অস্ত্র চালনা ও লাঠি খেলাও শেখানো হতো।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে নিজের গুরু হিসেবে মানতেন লীলা রায়। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার তাঁর সংগ্রামী জীবনে যে সমস্ত মহিলাদের কাছ থেকে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তার মধ্যে লীলা রায় অন্যতম।

নেতাজির অন্তর্ধানের পরে লীলা ফরওয়ার্ড ব্লকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন লীলা।

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের সংবিধান তৈরিতে লীলার ভূমিকা ছিল অনন্য। ‌ সংবিধানে মেয়েদের অধিকার নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন লীলা রায়।

লীলা রায় আসলে নিজেই একটা আলোর পথ। অন্য অনেক মেয়েদের তিনি সেই আলোর পথে চলতে সাহায্য করেছিলেন।‌ প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর যোগ্য উত্তরসূরী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...