কমিক স্ট্রিপের জনপ্রিয় চরিত্রঃ বাঁটুল দি গ্রেট


সময়টা পঞ্চাশ বা ষাটের দশক। এক লেখক গিয়েছেন পড়াশোনার জগতের মন্দিরে। কলেজস্ট্রিট। বই দেখার পাশাপাশি তিনি মানুষও দেখেন। আঁকেন। সৃষ্টির নেশা তাঁর সঙ্গী। তাঁর মাথায় গিজগিজ করছে চিন্তা। কমিক স্ট্রিপ তৈরীর খিদে তাঁর মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

সেদিন হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেল এক জগৎ-খ্যাত শরীরচর্চাবিদের সঙ্গে। মনোহর আইচ। সেই লেখকের মাথায় এল সৃষ্টিশীল চিন্তা। লেখক আবার আঁকিয়েও। লেখা আর আঁকা মিলেই তাঁর সৃষ্টি সম্পূর্ণ হয়।

তিনি সৃষ্টি করলেন এক চরিত্র। মজার। যার কর্মকাণ্ডে ভ্যানিশ হয়ে যাবে সব বিষন্নতা হতাশা, বিষন্নতা। সোজা কথায় যে কোনো দুঃখের মোক্ষম ওষুধ।

চরিত্রের নাম ‘বাঁটুল দি গ্রেট’। লেখকের নাম ‘নারায়ন দেবনাথ’।

FotoJet (7)

‘নারায়ণ দেবনাথ’- এই নামের সঙ্গে সম্পূর্ণ ছোটবেলাটাই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।

১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের এই সময়টায় প্রকাশিত 'শুকতারা' পত্রিকার অন্যতম আকর্ষণ ছিল কিছু ইলাস্ট্রেশন আর তার সঙ্গে জুড়ে থাকা গল্প। ঠিক গতানুগতিক গল্পের ছাঁচে তাদের ফেলা যায় না অথচ কি দুর্ধর্ষ সেই সব গল্পের আকর্ষণ।

বাঁটুল দি গ্রেটের মজার সব কাহিনী মানেই আনন্দ ভরা ছেলেবেলা। লেখক নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্টি এই চরিত্র। তার সঙ্গে ছিল অসাধারণ ইলাস্ট্রেশন। কিছু তিনি নিজেই আঁকতেন, কখনো আবার খ্যাতিমান আর্টিস্টদের দিয়ে আঁকাতেন। সব মিলিয়ে শৈশবকে ধরে রাখার কমিক স্ট্রিপ ছিল বাঁটুল দি গ্রেটের কাণ্ডকারখানা।

ছোটদের জন্য একেবারে আদর্শ ইলাস্ট্রেটর ছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। লেখার সঙ্গে আঁকা দুটোতেই থাকত তাঁর যত্নের ছাপ। একইসঙ্গে সিরিয়াস এবং নির্ভেজাল হাসির গল্পের ইলাস্ট্রেশন আঁকতে পারতেন সমানভাবে।

এই 'শুকতারা' পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদকের ইচ্ছেতেই প্রথমবার কমিক স্ট্রিপ লেখা শুরু করেন নারায়ণ দেবনাথ। সঙ্গে যোগ করেন ইলাস্ট্রেশনগুলো।

কেমন হবে সেই কমিক স্ট্রিপ-এর সব চরিত্র? ছোট্ট ছোট্ট কথার মাধ্যমে তারা জুড়তে পারবে তো নির্ভেজাল আনন্দের সঙ্গে?

এইসব চিন্তা যখন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল তখনই দেখা হয় মনোহর আইচের সঙ্গে। তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সৃষ্টি করেন বাঁটুল দি গ্রেট চরিত্রটি।

FotoJet (6)

১৯৬৫ সালের দেব সাহিত্য কুটির প্রকাশিত জৈষ্ঠ্য মাসের সংখ্যায় প্রথমবার আত্মপ্রকাশ করে ছেলেবেলার জাদুকর বাঁটুল।

গোলাপি রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি, সঙ্গে কালো রঙের টাইট হাফপ্যান্ট। খালি পা। এমনই ছিল এই চরিত্রের বর্ণনা।

এর বুকের ছাতি চল্লিশ ইঞ্চি। পা দুটো লিকলিকে সরু।

দুর্ধর্ষ শক্তিমান বাঁটুলের সঙ্গে থাকে তার দুই ভাগ্নে ভজা ও গজা, যদিও পরবর্তীকালে বাঁটুলকে তারা দাদা হিসেবে সম্বোধন করতো।

নারায়ণ দেবনাথের এই সৃষ্টি তাঁর ভাষাতেই, তাঁর 'ফেভারিট সন্তান'।

বাঁটুলের এছাড়াও অনেক সাঙ্গোপাঙ্গ ছিল। বিশেষ শ্রবণ ক্ষমতা সম্পন্ন কিশোর 'লম্বকর্ণ', পোষা উট পাখি 'উটো', পোষা কুকুর 'ভেদো' আর বুড়ি পিসিমা।

প্রথমদিকে বাঁটুল সেই ভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি।

তারপর ষাটের দশকে শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। লেখক সেই প্রেক্ষাপটে তাঁর কমিক স্ট্রিপ রচনা করতে শুরু করেন বাঁটুলকে নিয়ে। দেশপ্রেমী বলশালী বাঁটুল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শত্রুসেনার যুদ্ধ-ট্যাংক, বিমান সব ধ্বংস করতে শুরু করে। শত্রুকে মজার ছলে ধ্বংস করার এমন অভিনব পদ্ধতি আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছিল পাঠকদের কাছে।

জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বাঁটুল। সেই বিষন্ন সময়ে সকলের মুখে হাসি ফুটিয়েছিল এই চরিত্র।

FotoJet (8)

শুকতারার দ্বিতীয় পাতার 'বাঁটুল' হয়ে ওঠে জনপ্রিয় কমিক চরিত্র 'বাঁটুল দি গ্রেট'।

বাটুলের প্রথমদিককার দুর্লভ গল্পগুলি বই আকারে অগ্রন্থিত। প্রায় ৪৫ বছর ধরে চলতে থাকা বাটুলের চেহারাতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে পরিবর্তন। বর্তমানে তার কোমর আর পা সরু হয়েছে আর বেড়েছে বুকের ছাতি।

লেখক চিরকাল বাঁটুলের গল্প বলে এসেছেন। এখন সবই আধুনিক। ডিজিটালাইজড। দু-রঙা বাঁটুল এখন চার-রঙা হয়েছে। কম্পিউটারের মাধ্যমে আঁকায় পরিবর্তন এসেছে। নতুন করে আর এই চরিত্রের কাহিনী আমরা পাই না। পুরনোরা আজও প্রকাশিত হয়। নতুন রঙে। তবে তার জনপ্রিয়তার রং একই আছে সেই শুরুর সময় থেকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...